শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়–জীবনসঙ্গিনী ও বিবাহ বিতর্ক

ঠাকুরদাস মুখয্যের বর্ষাীয়সী স্ত্রী সাতদিনের জ্বরে মারা গেলেন ।  বৃদ্ধ মুখোপাধ্যায় মহাশয় ধানের কারবারে অতিশয়  সঙ্গতিপন্ন । তাঁর চার ছেলে, তিন মেয়ে , 

ছেলেমেয়েদের ছেলেপুলে হইয়াছে , জামাইরা প্রতিবেশীর দল চাকর-বাকর সে যেন একটা উৎস বাধিয়া গেল । 

সমস্ত গ্রামের লোক ধুমধামের শবযাত্রা ভিড় করিয়া দেখিতে আসিল । মেয়েরা কাঁদিতে কাঁদিতে মায়ের দুই পায়ে গাঢ় করিয়া আলতা এবং মাথায় ঘন করিয়া সিন্দুর লেপিয়া দিল বন্ধুরা ললাট চন্দনে চর্চিত পরিয়া বহুমূল্য  বস্তে শাশুড়ীরর দেহ আচ্ছাদিত করিয়া দিয়া আঁচল দিয়া তাঁহার শেষ পদধুলি মুখাইয়া লইল ।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলি জেলার  দেবানন্দপুর গ্রামে  ১৫ই সেপ্টেম্বর ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করে ।  আর্থিক সংকটের কারণে এফ এ শ্রেণীতে পড়ার সময় তাঁর ছাত্রজীবনের অবসান ঘটে । 

তিনি কিছুদিন ভবঘুরে  হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করেন । পরে ১৯০৩ সালে ভাগ্যের সন্ধানে বার্মা( বর্তমানে মায়ানমারে) যান এবং রেঙ্গুনে একাউন্ট্যান্ট জেনারেলের অফিসে কেরানি পদে চাকরি করেন ।

প্রবাস জীবনেই তাঁর সাহিত্য সাধনা শুরু এবং তিনি অল্প দিনেই খ্যাতি লাভ করেন ।  ১৯১৬ সালে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন এবং নিয়মিতভাবে সাহিত্য সাধনা করতে থাকেন ।

বস্তত তাঁর একক সাধনায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সকল শাখায় দ্রুত উন্নতি লাভ করে এবং বিশ্বদরবারে গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত হয় । তিনি একাধারে সাহিত্যিক দার্শনিক শিক্ষাবিদ নাট্য প্রযোজক ও অভিনেতা । 

কাব্য ,ছোটগল্প , উপন্যাস , নাটক ,প্রবন্ধ ,গান ,ইত্যাদি  সাহিত্যের সকল শাখাই তাঁর অবদানে সমৃদ্ধ । তাঁর অজস্র রচনা মধ্যে মানুষই সোনার তরী চিত্রা কল্পনা ক্ষণিকা বলাকা পু্নশ্চ চোখের বালি গোরা ঘরে বাইরে যোগাযোগ শেষের কবিতা ।

বিসর্জন ডাকঘর রক্তকবরী গল্পগুচ্ছ বিচিত্র প্রবন্ধ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।

২২শে শ্রাবণ ১৩৪৮ সালে (৭ই আগস্ট ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ) কলকাতার বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ।

পুষ্পে ,পত্রে ,গন্ধে ,মাল্যে , কলরবে মনে হইল না এ কোনো শোকের ব্যাপার–এ যেন বড় বাড়ির গৃহিণী পঞ্চাশ বর্ষ পরে আর একবার নতুন করিয়া তাঁহার স্বামীগৃহে  যাত্রা করিতেছেন । 

বৃদ্ধ মুখোপাধ্যায় শান্তমুখে তাঁহার চিরদিনের সঙ্গিনীকে শেষ বিদায় দিয়া অলক্ষে দুফোটা চোখের জল মুছিয়া  শোকার্ত কন্যা ও বধুগণকে সান্ত্বনা দিতে লাগিলেন । 

প্রবল হরিধ্বনিতে  প্রভাত আকাশ আলোড়িত করিয়া সমস্ত গ্রাম সঙ্গে সঙ্গে চলিল ।  আর একটি প্রাণী একটু দূরে থাকিয়া এই দলের সঙ্গী হইল ।  সে বাঙালির মা । 

সে তার কুটীর প্রাঙ্গণে বোটা -কয়েক বেগুন তুলিয়া এই পথে হাটে চলিয়াছিল , এই দৃশ্য দেখিয়া আর নড়িতে পারিল না ।  রহিল তাহার হাটে যাওয়া , রইল তাহার আঁচলে বেগুন বাঁধা–

সে চোখের জল মুছিতে মুছিতে সকলের পিছনে শ্মশানে আসিয়া উপস্থিত হইল ।

গ্রামের একান্তে গরুড়–নদীর তীরে শ্মশান ।  সেখানে  পূর্বাহ্নেই  কাঠের ভার, চন্দনের টুকরা ,মৃত , মধু , ধুপ ,  ধুনা প্রভৃতি উপকরণ সঞ্চিত হইয়াছিল বাঙালির মা  ছোটজাত , দুলের মেয়ে বলিয়া কাছে যাইতে সাহস পাইলো না । 

তফাতে একটা উঁচু টিপির মধ্য দাঁড়াইয়া সমস্ত  অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রথম  হইতে শেষ পর্যন্ত  উৎসুক আগ্রহে চোখ মেলিয়া দেখিতে লাগিল ।   প্রশস্ত্য  ও পর্যাপ্ত চিতার পরে যখন শব স্থাপিত করা হইল তখন তাঁহার রাঙ্গা পা–

দুখানি দেখিয়া তাহার দু চক্ষু জুড়াইয়া গেল ইচ্ছা হইল ছুটিয়া গিয়া একবিন্দু আলতা মুছাইয়া লইয়া মাথায় দেয় । 

বহু কন্ঠের হরিধ্বনির  সহিত পুত্রহস্তের মন্ত্রপুত্র অগ্নি যখন সংযোজিত হইল তখন  চোখ দিয়া ঝরঝর করিয়া জল পরিতে লাগিল , মনে মনে বারংবার বলিতে লাগিল ভাগ্যিমানি  মা ।

তুমি সগ্যে যাচ্চো আমাকেও আশীর্বাদ করে যাও , আমিও যেন এমনই বাঙালির হাতের আঙ্গুনতটুকু পাই । ছেলের হাতের  আগুন ! সে তো সোজা কথা নয় !

স্বামী, পুত্র , কন্যা  ,নাতি ,নাতনী , দাস ,দাসী,পরিজন সমস্ত সংসার উজ্জ্বল রাখিয়া এই যে স্বর্গারোহণ–দেখিয়া তাহার বুক ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে লাগিল – এ সৌভাগ্যর সে যেন আর প্রিয়তা করিতে পারিল না । 

সদ্য প্রজ্বলিত চিতার অযোগ্য  ধুঁয়া নীল রঙের ছায়া ফেলিয়া ঘুমিয়া ঘুমিয়া আকাশে উঠিতেছিল বাঙালীর  মা ইহারই মধ্যে ছোট একখানি রথের চেহারা যেন স্পষ্ট দেখিতে পাইল। গায়ে তাহার কত না ছবি আঁকা ,চূড়ায় তাহার কতনা লতাপাতা জড়ানো । 

ভিতরে কে যেন বসিয়া আছে- মুখ তাহার চেনা যায় না , কিন্তু সিথায় তাঁহার  সিঁদুরের রেখা , পদতল দুটি আলতায় রাঙ্গানো । ঊর্ধ্বদৃষ্টে চাহিয়া না কাঙ্গালির মায়ের দুই চোখে অশ্রুর ধারা বহিতেছিল ।

এমন সময়ে একটি বছর চোদ্দ -পনরর  ছেলে তাহার আঁচলে টান দিয়া কহিল হেথায় তুই দাঁড়িয়ে আছিস মা , ভাত বাঁধবি নে ?

মা  চমকিয়া ফিরিয়া চাহিয়া কহিল , ধরবো খন রে ! হঠাৎ উপরে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া ব্যগ্রস্তেেরে কহিল দ্যাখ দ্যাখ  বাবা- বামুন -মা ওই রথে চড়ে সগ্যে যাচ্ছে ! দ্যাখ বাবা–

রামুন মা ওই রথে চড়ে সগ্যে যাচ্ছে !

ছেলে বিস্ময়ে মুখ তুলিয়া কহিল কৈ ? ক্ষনকাল নিরীক্ষণ করিয়া শেষে বলিল , তুই ক্ষেপেছিস ! ও ত ধুয়া রাগ করিয়া করিল , বেলা দুপুর বাজে , আমার খিদে পায় না বুঝি ?

এবং সঙ্গে সঙ্গে মায়ের চোখে জল লক্ষ্য করিয়া বলিল,  বামুনদের গিন্নী মরছে, তুই কেন কেঁদে মরছিস মা ?

বাঙালীর মা এতক্ষন হুঁশ হইল । পরের জন্য  শ্মশানে দাঁড়াইয়া এইভাবে অশু পাত  করায় সে মনে মনে লজ্জা পাইল , এমন কি , ছেলের অকল্যাণের আশঙ্কায় মুহূর্তে চোখ বুঝিয়া ফেলিয়া একটুখানি হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল ।

কাঁদব  কিসের জন্য রে ! চোখে ধোঁ লেগেছে বৈ ত নয় !

হাঃ ধোঁ লেগেছে বৈ ত না ! তুই কাঁদতেছিলি ! 

মা আর প্রতিবাদ করিল না । ছেলের হাত ধরিয়া ঘাটে নামিয়া নিজেও  স্নান করিল ,  বাঙালিকে ও স্নান করাইয়া ঘরে ফিরিলো শ্মশানে সৎকারের  শেষটুকু দেখা আর তার ভাগ্য ঘটিলো না । 

সন্তানের নামকরণকালে পিতা-মাতা  দৃঢ়তায় বিধাতাপুরুল অন্তরীক্ষে থাকিয়া অধিকাংশ সময়ে শুধু হাস্য করিয়ায় ক্ষান্ত হয় না ,  তীব্র প্রতিবাদ করেন । তাই তাহাদের সমস্ত জীবনটা তাহাদের নিজের নাম গুলোকেই যেন আমরণ  ভ্যাঙ্গচাইয়া চলিতে থাকে । 

বাঙালীর মার জীবনের ইতিহাস ছোট কিন্তু সেই ছোট বাঙাল জীবনটুকু বিধাতার এই পরিহাসের দায় হইতে অব্যাহতি লাভ করিয়াছিল ।  তাহাকে জন্ম দিয়ে  মা মরিয়াছিল ,বাপ রাগ করিয়া নাম দিল অভাগী ।

মা নাই , বাপ নদীতে মাছ ধরিয়া বেড়ায় ,তাহার নাম আছে দিন , না  আছে রাত ।  তবু যে কি করিয়া ক্ষুদ্র অভাগী একদিন বাঙালির মা হইতে বাকি রহিল সে এক বিস্ময়ের বস্তু । 

যাহার শহীদ তো বিবাহ হইল তাহার নাম রসিক বাঘ ,বাঘের অন্য বাঘিনী ছিল , ইহাকে লইয়া সে গ্রামান্তরে উঠিয়া গেল , অভাগী তাহার অভাগ্য ও শিশু পুত্র বাঙালিকে লইয়া গ্রামেই কড়িয়া রহিল । 

তাহার এই বাঙালি বড় হইয়া আজ পনরয় পা কি  দিয়াছে ।  সবেমাত্র ব্যাটের কাজ শিখিতে আরম্ভ করিয়াছে ,  অভাগীর আশা হইয়াছে আর ও বছরখানেক তাহার অভাগ্যের সহিত বুঝিতে পারিলে দুঃখ  ঘুচিবে ।

এই দুঃখ যে কি ,  যিনি  দিয়াছেন তিনি ছাড়া আর কেহই জানে না । 

বাঙালী  কুকুর হইতে আচাইয়া আসিয়া দেখিলো তাহার পাত্রের  মুক্তাবশেসষ মা একটা মাটির পাত্রে ঢালিয়া রাখিতেছে ,  আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল তুই খেলি না মা? ছেলে বিশ্বাস করিল না ।  বলিল, না ,  খিদে নেই বৈ কি !কৈ দেখি তোর হাঁড়ি ?

এই ছলনায় বহুদিন বাঙালীর মা বাঙালিকে ফাঁকি দিয়ে  আসিয়াছে ।  সে হাঁরি দেখিয়া তবে ছাড়িল । তাহাতে আরো একজনের মত ভাত ছিল ।

তখন সে প্রসন্নমুখে মায়ের কোলে গিয়া বসিল ।  এই বয়েসের ছেলে  সচরাচর এরূপ করে না , কিন্তু শিশুকাল হইতে বহোকাল যাবত সে রুগ্ন ছিল বলিয়া মায়ের ক্রোড় ছাড়িয়া বাহিরের সঙ্গীসাথীদের  সহিত  মিশিবারসুযোগ পায় নাই ।

এইখানে বসিয়াই তাহাকে খেলাধুলায় স্বাদ মিটাতে হইয়াছে ।  এক হাতে গলা জড়াইয়া ,  মুখের উপর মুখ  রাখিয়াই বাঙালি চকিত  হইয়া রহিল , মা , তোর গা যে গরম ,কেন তুই অমন রোদে দাঁড়িয়ে  মড়া পোড়ানো দেখতে গেলি? কেন আবার নিয়ে এলি?

মড়া  পোড়ানো কি তুই– মা  শশব্যস্তে  ছেলের মুখে হাত চাপা দিয়া কহিল,  ছি বাবা ,  মড়া পোড়ানো বলতে নেই ,  পাপ হয় ।  সতী– লক্ষ্মী  মা ঠাকরুন রথে  করে সগ্যে গেলেন ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *