তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা শীর্ষক কবিতাটি শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা শীর্ষক কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে । কবিতাটি কবির বন্দী শিবির থেকে নামক কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত । স্বাধীনতা শুধু শব্দমাত্র নয়, এটি এমন এক অধিকার অনুভব যা মানুষের জন্মগত।
কিন্তু পাকিস্তানিরা বাঙ্গালীদের স্বাধীনতা হরণ করেছিল। এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ১৯৭১ সালে আপামর বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে ।
যুদ্ধচলাকালে বাঙালির রক্তে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয় পাকিস্তানি যুদ্ধবাজরা । বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে সকিনা বিবির মতো গ্রামীণ নারীর সহায় সম্বল সম্ভম বিসর্জিত হয়েছে হরিদাসী হয়েছে স্বামীহারা, নবজাতক হারিয়েছে মা-বাবাকে ।
বাঙ্গালীদের ছাত্রাবাস আক্রমণ করে ছাত্রদের হত্যা করে শহরের বুকে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে গণহত্যা চালায়, ফুরিয়ে দেয় গ্রাম ও শহরের লোকালয় । এর প্রাকৃতিক প্রতিবাদ উঠে পশুর কন্ঠেও । আর্তনাদ করে কুকুরও ।
মুক্তিযুদ্ধের শ্রমিক কৃষক জেলে রিকশাওয়ালা প্রমূখ সাধারণ মানুষ আত্মত্যাগ করে । দগ্ধ হওয়া লোকাল প্রবীণ বাঙালির আলোকিত চোখে চেয়ে থাকে ।
সেই সঙ্গে নবীন রক্তে প্রাণস্পন্দন ও আশা জেগে থাকতে দেখে খুবই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেন এত আত্মত্যাগ যার উদ্দেশ্য সেই স্বাধীনতাকে বাঙালি একদিন ছিনিয়ে আনবেই ।
শামসুর রাহমান ১৯২৯ সালের ২৪ শে অক্টোবর ঢাকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর পৈতৃক নিবাস নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার পাহাড়তলী গ্রামে । তাঁর পিতা মোখলেসুর রহমান চৌধুরী ও মাতা আমেনা খাতুন ।
তিনি ১৯৪৫ সালে ঢাকার পোগোজস্কুল থেকে ম্যাট্রিক ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর পেশা ছিল সাংবাদিকতা ।
তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা
তোমাকে পাওয়ার জন্য
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খান্ডবদাহন?
তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা,
সাকিনা বিবির কপাল ভাঙল,
সিথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর।
তুমি আসবে বলে,হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাই রংয়ের ট্যাক্স এলো।
দানবের মতো চিৎকার করতে করতে
তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস , বস্তি উজার হলো । রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খুই ফোটাল যত্রতত্র।
তুমি আসবে বলে ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।
তুমি আসবে বলে বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভুর বাস্তভিটার
ভগ্নস্তুপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করল একটা কুকুর।
তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা।
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতা মাতা লাশের উপর।
তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা তোমাকে পাওয়ার জন্য।
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন
স্বাধীনতা তোমার জন্য থুখুড়ে এক বুড়ো
উদাস দাওয়ায় বসে আছেন,তার চোখের নিচে অপরাহ্নের
দুর্বল আলোর ঝিলিক বাতাসে লড়ছে চল।
স্বাধীনতা, তোমার জন্য
মোল্লাবাড়ির এক বিধবা দাঁড়িয়ে আছে
নড়বড়ে খুঁটি ধরে দগ্ধ ঘরের।
স্বাধীনতা তোমার জন্য
হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে
বসে আছে পথের ধারে।
তোমার জন্য,
সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক
কেষ্ট দাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা
মতলব মিয়া, মেঘনা নদী দক্ষ মাঝি
গাজী গাজী বলে যে নৌকা চালায় উদ্দাম ঝরে
বুস্তম শেখ, ঢাকায় রিকশাওয়ালা যার ফুসফুস
এখন পোকার দখলে
আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুরে- বেড়ানো
সেই তেজি তরুণ যার পদভাবে
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্য হে স্বাধীনতা।
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত
ঘোষণার ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি তুলে
নতুন নিশান উড়িয়ে দামামা বাজিয়ে দিগ্নিদিক
এই বাংলায়,
তোমাকে আসতেই হবে হে স্বাধীনতা।
তিনি একনিষ্ঠ ভাবে কাব্যসাধনায় নিয়োজিত ছিলেন । বিশেষ করে মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের প্রত্যাশা হতাশা বিচ্ছন্নতা বৈরাগ্য ও সংগ্রাম তার কবিতায় স্বার্থকভাবে বিধৃত।
তার কবিতায় অতি আধুনিক কাব্যধারার বৈশিষ্ট্য সার্থকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। উপমা ও চিত্রকল্পে তিনি প্রকৃতিনির্ভর এবং বিষয় ও উপাদানে শহরকেন্দ্রিক ।
স্বাধীনতার যুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙ্গালীদের উপর বীভৎস ও ভয়ংকর আক্রমণ চালায়। তারা গ্রামের পর গ্রাম আগুনে পুড়িয়ে দেয়। তাদের সেই আক্রমণ থেকে ছাত্রদের ছাত্রবার গরীবমানুষের থাকার জায়গা বস্তি ও রক্ষা পায়নি।
পাকিস্তানি সেনারা ছাত্রাবাস ও বস্তিতেও আক্রমণ করে, এবং সেখানকার মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে এবং পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। থুথুরে এক বুড়ো বয়সের ভারে বিধ্বস্ত লোক যার বয়স অনেক হয়েছে এবং চলাচল করতে যায় কষ্ট হয়।
রুস্তম শেখ এখন পোকার দখলে রুস্তম শেখ নামের এক রিক্সাওয়ালা যিনি যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। মৃত্যু অবস্থা বোঝানোর জন্য বলা হয়েছে যার সুখদুখ এখন পোকার দখলে।