কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি বলা হয় তার সাহিত্যকর্মের বিশালতা, গভীরতা এবং প্রভাবের কারণে। তিনি একজন বিদ্রোহী কবি, যিনি তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে সামাজিক ও রাজনৈতিক অসঙ্গতিকে তুলে ধরেছেন এবং মানুষের মুক্তি ও আত্মমর্যাদাবোধের কথা বলেছেন। তার সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের একটি অমূল্য সম্পদ, যা সমগ্র বাঙালি জাতির হৃদয়ে গভীরভাবে প্রোথিত।
কাজী নজরুল ইসলামের জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- তার সাহিত্যকর্মের বৈচিত্র্যময়তা: কাজী নজরুল ইসলাম একজন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি কবিতায়, সঙ্গীতে, নাটকে, প্রবন্ধে, ছোটগল্পে, উপন্যাসে এবং নাটকে সমানভাবে পারদর্শী ছিলেন। তার সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, ইত্যাদি।
- তার সাহিত্যের গভীরতা ও প্রভাব: কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্ম অত্যন্ত গভীর ও প্রভাবশালী। তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে তিনি মানুষের মনের গভীরে প্রবেশ করেছিলেন এবং তাদেরকে জাগ্রত করেছিলেন। তার সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে একটি অমূল্য সম্পদ, যা সমগ্র বাঙালি জাতির হৃদয়ে গভীরভাবে প্রোথিত।
- তার সাহিত্যের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব: কাজী নজরুল ইসলাম একজন সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী চিন্তাবিদ ছিলেন। তার সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক অসঙ্গতিকে তুলে ধরেছেন এবং মানুষের মুক্তি ও আত্মমর্যাদাবোধের কথা বলেছেন। তার সাহিত্যকর্ম বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
এইসব কারণেই কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
কাজী নজরুল ইসলামঃ নজরুল আমেয় প্রাণবয়তার বহ্নিমান প্রতিমূর্তি । তাঁর ললাটে চিরযুবনের রাজটিকা । কবির কাব্য জগতে প্রবেশ করলে ঊর্ধ্বকাশে দেখি গড় ঝএার আলোরন নিম্নদেশে মাটির শ্যামল কোমলতা ।
বাঙালির ললিত গীতের রাজ্যে তিনি আমাদের শোনালেন রণক্ষেত্রের তূর্যধ্বনি । নজরুল রক্ত টগবগানো গান গেয়ে তরুণ প্রাণ সবলে কেড়ে নিয়েছেন । তাই তাঁর প্রতি আমার অনুরাগসিক্ত অত্যাধিক ।
নজরুল কেন প্রিয়ঃ বাংলা ভাষায় কোভিদ সংখ্যা কম নয় । তাঁরদের মধ্যে একজন তো মহাপ্রতিভাধর রবীন্দ্রনাথ সত্যন্দনাথ যতীন্দ্রনাথ মোহিতলাল জীবনানন্দ সুধীন্দ্রনাথ শুক্রান্ত প্রমূখ্য বিশিষ্ট কবিরা ও আছেন ।
তবুও নজরুল যে আমার এত প্রিয় তার কারণ হলো–নজরুলের কবিতার সংসারে আমার নির্বাধ আনাগোনা ।
ভাবের সমুচ্চতা (Sublimity) কিংবা চিন্তার জটিলতা ভাষার কাঠিন্য কিংবা প্রকাশভঙ্গির সূক্ষ্মতা কিছুই আমাকে এখানে বাধা দেয় না । এ কোভিদ কবিতা বুঝবার জন্য নয় । হৃদয়টি খুলে ধরে কান পেতে শুনলেই হলো ।
বাংলাদেশের রণ সংগীত
চল চল চল ঊর্ধ্ব গগনে বাজে বাদল গানটি বাংলাদেশের রণ সংগীত । গানটির গীতিকার সুরকার এবং শিল্পী হলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ।গানটি সন্ধ্যা কাব্যগ্রন্থ হতে সংকলিত ।
নতুনের গান শিরোনামে ঢাকার শিক্ষা পত্রিকা সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় । সাধারণত উৎসব অনুষ্ঠানের রণ সংগীত এর ২১ চলন বাজানো হয় ।
নজরুলের আবির্ভাবকালঃ নজরুলের আবির্ভাব ঘটে ১৮৯৯ সালে । ভারতবর্ষের এক অস্তিতিশীল পরিবেশে বড় হয়েছেন তিনি । .১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হলে নজরুল সেনা দলে যোগ দিলেন । স্কুলের পড়া ছেড়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে করাচিতে চলে এলেন ।
যুদ্ধ শেষ হলে (১৯১৮)নজরুল হাবিলদার হয়ে ফিরে এলেন । তখন তাঁর বয়স ১৮-১৯ । এ সময়ে বিপ্লবী বীর বারীন ঘোষের সাথে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে তিনি বাঁধা পড়লেন । মেতে গেলেন স্বদেশী হাঙ্গামায় ।
জেলে গেলেন বেদুইন নজরুল অগ্নিমন্তে দীক্ষা নিলেন ভাঙ্গার গান লেখার প্রেরণা পেলেন । এভাবে উদ্দাম বিদ্রোহী কবিজীবনে তাঁর নেমে পড়ার ক্ষেত্রটি প্রস্তুত হতে লাগল । নজরুল ইসলামের প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা বেরুল ১৯২২ সালে ।
বিদ্রোহীর ভূমিকায়ঃ সাহিত্য জগতে তখন চলছে রবীন্দ্রনাথের বলাকা’র যুগ ।রবীন্দ্রনাথ যখন বাঁধনহারা দুরন্ত যৌবনের জনসংগীত উচ্চারণ করেছিলেন, তখন তিনি আধমরাদের ঘা দিয়ে বাঁচাবার জন্য নিত্যজীবী সবুজকে দুরন্ত কাঁচা অবুজকে -হাঁক ছেলে ডাক দিচ্ছিলেন তখনই চির অশান্ত নজরুলের কবি প্রতিভার উন্মেষা ।
রবীন্দ্রনাথের সবুজের অভিযানের নজরুল যোগ না দিয়ে পারেননি । তিনি ঝড়ের মাতমে বিজয়কেতন নেড়ে অট্টহাস্যে আকাশখানি ফেঁরে বিদ্রোহী’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন ।
রচনাবলিঃ নজরুল একের পর এক লিখে চললেন উদ্দামতা ভরা কবিতা আর গান। এক এক করে বেরুল অগ্নি বীণা বিষের বাঁশী প্রলয়শিখা ভাঙ্গার গান, সর্বহারা সাম্যবাদী প্রবৃত্তি বাক্যগ্রন্থ । সেদিন রাজরোষ কবির উন্নত শিকড়ে অবনমিত পড়তে পারেনি ।
বজ্রমন্তে তিনি ঘোষণা করলেন আমি বেদুইন আমি চেঙ্গিস আমি আপনারে ছাড়া করিনা কাহারে কুর্ণিশ ।বিদ্রোহী কারো কাছে মস্তক নত করে না । সর্বপ্রকার অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে তাঁর আপসহীন সংগ্রাম । আর শান্তি সম্বন্ধে উচ্চকণ্ঠে বলা হলো –
যাবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন- রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ ভুমে রনিবে না-
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত ।
নজরুল নির্যাতিত মানবতার কবি, সর্বহারা মানুষের ব্যথার কাব্যকার তিনি । অত্যাচারিত মানবগোষ্ঠীর আর্তনাদ তিনি শুনেছেন । মনুষ্যত্বের লাঞ্ছনা তাঁর প্রাণ পুরুষকে বিদ্রোহী করে তুলেছে ।
উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোলই তাঁকে যুগিয়েছে হাতে লেখনীয় তলোয়ার তুলে নেবার প্রেরণা । নজরুল ইসলাম সংগ্রামী কবি, শিল্পী যোদ্ধা । কবিতাকে তিনি যুদ্ধের হাতিয়ারে পরিণত করলেন ।
শ্রেণীর সম্প্রদায় বৈষম্যবিরোধী
শ্রেণীবৈষম্য ধনী দরিদ্রের প্রভেদ দুর্বলের রক্ত শোষণ মানব প্রেমিক কবিকে একেবারে ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল । সমানাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সুস্থ মানব সমাজের প্রতি তাঁর সৃষ্টি ছিল স্থিরবদ্ধ ।
সমষ্টিক মানুষের কল্যাণী ছিল তাঁর পার্থিত । তিনি বুঝেছিলেন মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই । আর সাম্প্রদায়িকতা কিংবা জাতিভেদ মূলক কোনো প্রশ্ন করিব চিওকে সংকীর্ণতার পথে পরিচালিত করেনি ,তাঁর কাছে স্বদেশ ও স্বজাতিই ছিল সবচেয়ে বড় সত্য ।
হিন্দু আর মুসলমানকে তিনি বাংলা মায়ের দুই সন্তান রূপে দেখেছিলেন । তিনি জানতেন হিন্দু মুসলমান একই বৃন্তে দুটি কুসুম । তাই ১৯২৬ সালে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা শুরু হলে খুবই কান্ডারী হুশিয়ার ধ্বনিতে বললেন–
হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী !বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার !
দোষে গুণে নজরুলঃ নজরুল ইসলাম কবিতা লিখেছেন প্রচুর গান লিখেছেন অসংখ্য । এসব কবিতা ও গানের বৈচিত্র্য ও কম নয় । তাঁর লেখায় দোষ গুণ দুই- ই আছে । কবিতা গুলোতে একদিকে দেখা যায় পবিত্বশক্তির আশ্চর্য অজস্রতা অন্যদিকে দেখা যায় ওই শক্তির উৎশৃংখল অপচয় ।
তার কারণ কবি কখনো সতর্ক হয়ে লেখেননি, লেখার পরিমার্জনা কাকে বলে তা জানতেন না । তাই এগুলোর মধ্যে শিল্পসংগত পারিপাট্যের অভাব লক্ষণীয় । গানগুলো অধিকাংশই ফরমায়েশী ।
কাজেই কবির বেশিরভাগ গানে নিবিড় রসানুভূতির স্পন্দন নেই- তবে দেশ প্রেমের গানে ভক্তির গানে সত্যি তিনি নির্দিষ্টচিও শিল্পী সাধক। কবিতার শিল্পী গত অপরিচ্ছন্নতা এ সঙ্গীতে তিনি অনেকটা কাটিয়ে উঠেছেন । এসব দোষ গুণ নিয়েই নজরুলের কাব্য প্রতিভা ।
বর্তমানের কবিঃ খুব বড় হবার বাসনা নজরুল পোষণ করতেন না । নিজের ক্ষমতার সীমা কোথায় , তা তাঁর অজানা ছিল না । যুগের দাবিকে স্বীকার করে নিয়ে বিদ্রোহের সুরে গান বাাধতে তিনি এসেছেন এবং তা-ই তাঁর কাছে যথেষ্ট মনে হয়েছে ।
তিনি তো নিজেই আমাদের শুনিয়েছেন, বর্তমানে কবি আমি ভাই , ভবিষ্যতের নই নবী । এতে সমালোচকদের কাজ অনেকখানি সহজ হয়ে গেছে । নজরুলের এ উজ্জ্বল অনন্যতা সর্বজস্বীকৃত ।
উপসংহারঃ নজরুল ইসলাম আমাকে তাঁর অফুরন্ত প্রাণের জাদুঘরা সান্নিধ্যে নিয়ে আসেন । সৈনিক ব্রত নিতে উৎসাহিত করেন । সৈনিক হতে চাই আমি । এ কারণে তিনি আমার একান্ত প্রিয় কবি ।
আমারে মনোভঙ্গি যাদের রয়েছে তারা নজরুলকে অবশ্যই নিজেদের প্রিয় কবি বলেই জানবেন ।