মাতৃভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা রচনা

পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের কাছে তার মাতৃভাষা শ্রেষ্ঠ । মানুষ মাত্রই তার নিজস্ব মাতৃভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করে সবচেয়ে অধিক তৃপ্তি লাভ করে । স্বদেশি ভাষা বলতে মাতৃভাষাকে বোঝায় । মাতৃভাষা যত সহজে বোধগম্য হয় অন্য ভাষা তত সহজে বোধগম্য নয় ।

পরিপূর্ণভাবে মনের ভাব প্রকাশের যে পরিতৃপ্তি তার স্বদেশী ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষা পাওয়া যায় না । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, শিক্ষায় মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ স্বরূপ । মাতৃদুগ্ধ শিশুর পক্ষে যেমন পুষ্টিকর বিদ্যা শিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষা তেমন সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম । প্রতিদিনের ভাবের আলাপন সুখ দুঃখ আশা নৈরাশ্য আনন্দ বেদনা স্বপ্ন কল্পনার প্রকাশ হয় মাতৃভাষায় ।

বিদেশি ভাষায় যতই দক্ষতা অর্জন করুক মাতৃভাষার ন্যায় এমন  সাবলীলভাবে মনের ভাব প্রকাশ করা বিদেশি ভাষায় সম্ভব নয় । মাতৃভাষা যেমন প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার অবলম্বন তেমনি চিন্তা চেতনা জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনার মাধ্যম হিসেবেও মাতৃভাষার কোন বিকল্প নেই ।

মাতৃভাষায় জ্ঞান জ্ঞনানুশীলন  ব্যতীত বিশ্বে কোনো জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে নি । ইংরেজরা যেদিন ফরাসি ভাষাকে মাতৃভাষার উপরে স্থান দিয়েছিল তখন সে দেশের সাহিত্যের স্ফুরণ হয় নি ।

স্ফুরণ হয়েছিল যেদিন মার্টিন লুথার মাতৃভাষায় পবিত্র বাইবেলের অনুবাদ করে দেশের মানুষের বাইবেল ও মাতৃভাষা উভয়কেই অসীম মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা করলেন । রাশিয়া ও মাতৃভাষাকে স্বীকার করেই জ্ঞান-বিজ্ঞান শিল্প- সাহিত্যের  গৌরবময় অগ্রগতির পথে বিশিষ্ট মর্যাদায় বিনীত হয়েছে । 

প্রাচ্যের জাপানও একদিন প্রতিচ্যের শিক্ষা ধারাকে গ্রহণ করেছিল । সেদিন তার অগ্রগতি ছিল কুণ্ঠিত । তারপর মাতৃভাষার মাধ্যমে তারা অগ্রগতির পথে এগিয়ে গেছে । মাতৃভাষা এই মানুষের মত প্রকাশের সর্বোত্তম বাহন ।

যে জাতির পৃথিবীতে শিক্ষা দীক্ষা জ্ঞানচর্চা গবেষণা ইত্যাদি কাজে মাতৃভাষার যত বেশি চর্চা করেছে সে জাতি তত বেশি উন্নতি হয়েছে । মাতৃভাষার ব্যাপক চর্চা ও প্রয়োগ ছাড়া জাতীয় বিকাশ সম্ভব নয় ।

তাই মায়ের উপর আঘাত আসলে সন্তান যেমন চুপ থাকে না ,তেমনি মাতৃভাষার উপুর  আঘাত নেমে আসলেও সন্তানেরা মৃত্যুঞ্জয়ী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে । ১৯৫২,  ১৯৭১ হালগুলো সেই  সংগ্রামেরই প্রতীক হয়ে আছে ।

ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে মাতৃভাষার  মর্যাদা যেমন রক্ষিত হয়েছিল, তেমন ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পেয়েছিল স্বাধীনতা ও  সার্বভৌমত্ব । যেকোনো মানুষ তার মাতৃভাষাকে ভালোবাসে। কিন্তু এমন কিছু ষড়যন্ত্রকারী থাকে, যারা মিথ্যা অভিনয় করে বরং মাতৃভাষাকে ক্ষতিসাধন করার চেষ্টা করে ।

এদের সম্পর্কে ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন  মাতৃভাষার প্রতি যারা অনুরাগহীন তারা পশু বিশেষ ।  এরকম ষড়যন্ত্রকারী ও ভন্ড দেশ প্রেমিকদের হাত থেকে মাতৃভাষা রক্ষা করার শপথ নিয়েই সবাইকে অগ্রসর হতে হবে ।  যেকোনো দেশের নাগরিকের জন্যই এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্য ।

মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করতে প্রধানত যে ভাষা ব্যবহার করে, সেটা হল মাতৃভাষা । মায়ের কাছে শেখা ভাষাতেই নিজস্ব পরিমন্ডলে মানুষ জ্ঞান শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জন করে ।

আমাদের শিক্ষাজীবনে  মাতৃভাষার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন- কোনো শিক্ষাকে স্থায়ী করিতে হইলে, গভীর করিতে হইলে ব্যাপক করিতে হইলে তাহাকে চির পরিচিত মাতৃভাষায় বিগলিত করিয়া নিতে হয় । 

যেকোনো জাতির কাছে প্রিয় ভাষা হলো তাদের মাতৃভাষা ।  আর সেই মাতৃভাষার উপর যদি নিষেধাজ্ঞা আসে তাহলে তার মতো অপমান ও আঘাতের আর দ্বিতীয়  উদাহরণ থাকতে পারে না ।  ঠিক এমনটিই ছিল ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা তথা মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্বেও এই বাংলাকে  পরিত্যাগ করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী জোরপূর্বক উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় ।

কিন্তু বাংলার তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রাখতে বুকের তাজা রক্ত  রাজপথে ঢেলে দিয়েছিল ।  বৃষ্টি হয় এক তাৎপর্যপূর্ণ দিবস ২১শে ফেব্রুয়ারি ।

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি রক্ত ও শহিদের আত্মদানের মাধ্যমে বাঙালিরা তাদের মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার যে ইতিহাস রচনা করেছিল তা বিশ্বে অনন্য । একই রকম ঘটনা ঘটেছিল ১৯৬১ সালের ১৯ মে ভারতের আসাম প্রদেশের শিলচর স্টেশনে।

সেখানে অসমিয়া ও বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে ১১জন শহীদ হয়েছিলেন । এই অনন্য ইতিহাস স্মরল ও মাতৃভাষার মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতিবছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হচ্ছে ।

বাংলাদেশে স্থাপিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট । মাতৃভাষা পরস্পর  ও অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ । মায়ের কাছ থেকে শেখার মাধ্যমে এই ভাষাতেই সর্বোচ্চ সুন্দর ও  সাবলীলভাবে আমরা মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি ।

ড.মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ মাতৃভাষাকে মাতৃস্তন্যের সাথে তুলনা করেছেন । আজন্ম যে ভাষার সাথে মানুষের পরিচয় যে ভাষার মাধ্য দিয়ে  শিশু মাতা-পিতা আত্মীয় ও অন্যদের  সাথে মনের অভিব্যক্তি ব্যক্ত করে, সেই ভাষাই তার  সাথে , অস্থিমজ্জার সাথে মিশে থাকে ।

মা মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ  অনুষঙ্গ আমাদের ব্যক্তি, সমাজ তথা জাতীয় জীবনে খুবই তাৎপর্য বহন করে । এই ধরার সুন্দর  সুশীতল দেওয়ার জন্যই  মমতাময়ী মা সন্তানের  জন্ম দেন ।  মায়ের অকৃত্রিম আদর স্নেহ ও ভালোবাসায় বেড়ে উঠতে থাকে নবজাতক ।

একদিন সেই শিশুটি আধো বুলি ছেড়ে মা উচ্চারণ করতে থাকে । মায়ের কাছ থেকে  শেখা ভাষাতেই সে কথা বলতে শুরু করে । মাতৃভাষার এমন সেতুবন্ধন প্রতিটি মানুষেরই  জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ।

আর সেই মায়ের  সংস্পর্শেই আলো বাতাস, প্রকৃতি তথা চারপাশের সবকিছুর সাথে গড়ে উঠে এক অবিচ্ছেদ‍্য সম্পর্ক ।  যেহেতু জন্মের পর সে সর্বপ্রথম এই ভূমিকেই চিনতে পারে । এ জন্য  মাতৃভাষার মতো মাতৃভূমি ও তার জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ । 

মমতাময়ী মা, কবি জসিমউদ্দিন বলেছেন-

দুঃখের সয়রে মায়ের এক সুখ

রঙিন ঝিনুকে  পোঁরা মুক্তা এতটুকু ।

পৃথিবীতে যেকোনো মানুষের অতি আপনজন হলো তার মা । মায়ের স্নেহের ও আদর যত্নে বেড়ে ওঠে মানবশিশু । আর এই সন্তানকে গর্ভে ধারণ করা থেকে শুরু করে বড় করে গড়ে  তুলতে জীবনভর মায়ের যে ত্যাগ স্বীকার করতে হয় তার ঋণ কোনদিন শোধ হবার নয় । 

যেকোনো ধরনের বিপদের হাতছানি এলে মা তার সন্তানকে আগলে রাখেন । সন্তানের অমঙ্গলের  আশঙ্কায়  উদ্বিগ্ন থাকেন । রোগগ্রস্থ সন্তানের শয্যা পাশে মাকে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয় ।  নিজের কথা ভুলে গিয়ে সন্তানের সুখের আশায় তার দিন কাটে ।

সন্তানের সুখের মধ্যেই মা তার খুঁজে পান । সন্তানকে একটু ভালো খাওয়াতে বা করাতে পারলে মায়ের সুখের অন্তর থাকে না । অভাবের ঘরে যার বসবাস,  সেই মা ও নিজে না খেয়ে কষ্টার্জিত অন্ন তুলে দেন সন্তানের মুখে ।

শিক্ষা দীক্ষায় আচরণে সন্তান বড় হলে মাতৃত্বের সার্থকতায় মায়ের মন ভরে ওঠে । সন্তানের অস্তিত্বের মধ্যেই নিষেধ থাকে মায়ের অস্তিত্বের প্রমাণ । এই পৃথিবীতে সন্তানের কাছে মা তাই সর্বদা স্নেহময়ী মঙ্গলময়ী ও মহিমাময়ী জননীরূপে বিরাজ করেন । 

মায়ের কাছে সবাই সমান ।  দুঃখ যন্ত্রণা সহ্য করে বৈন্য ও  তুচ্ছতাকে  বরণ করে মা হন সর্বসংহা । মায়ের ভালোবাসাই আমাদের মধ্যে অন্য মানুষদেরকে ভালবাসতে শেখায় ।  তাই মা পরম প্রেমের স্নেহের ও ভালোবাসার উৎস ।

মায়ের আদর স্নেহে পালিত শিশুটি যে ভূমিতে দিন দিন বড় হতে থাকে সেটাই তার মাতৃভূমি ।  আর  মাতৃভাষা প্রতিও তার  অকৃত্রিম ভালোবাসা জন্ম নেয় ।

কবি  লর্ড রায়রন বলেছেন মাতৃভাষা যে ভালবাসতে পারে না তার পক্ষে অন্য কিছুকে ভালোবাসা সম্ভব নয় ।  অনেক কবি সাহিত্যকই মাতৃভাষাকে  স্বর্গের মহিমায়  গৌরবান্বিত করেছেন । প্রত্যেক মানুষেরই মাতৃভাষা রয়েছে । 

আর সেই মাতৃভাষার সাথে রয়েছে তার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক কিন্তু মাতৃভাষা স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠার পরিবেশ থাকাটা বাঞ্চনীয় ।  কেননা মাতৃভাষা যদি পরাধীনতার  শৃউখলে বন্দী থাকে তবে কারো জীবনেই সুখকর হতে পারে না । 

তাই মাতৃভাষা স্বাধীনতা ও অত্যাবশ্যক । শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর যেমন দিনে দিনে বেড়ে ওঠে তেমনি পৃথিবীর আলো বাতাস তাপের সম্পর্কের লালিত হয় ।  তাই মাতৃভূমিকে মায়ের সাথে তুলনা করা হয়েছে ।

খুবই গোবিন্দদাসের কাব্যে এভাবে ফুটে উঠেছে ।মা  থেকেই মাতৃভাষা আর সেই মাতৃভাষার প্রতি হৃদয়ের গভীর আকুতি থেকে প্রতি মমত্ববোধ জেগে ওঠে 

উপসংহার

মাতৃভাষা ব্যক্তিজীবন তথা জাতীয় জীবনে এদের গুরুত্ব অপরিসীম ঋণ ও পরিশোধ্য । সেই ব্যক্তিই সত্যিকারের মানুষ যার চিন্তা ও কর্মে সর্বদা মাতৃভাষার প্রতি রয়েছে অগাধ মমত্ববোধ । একজন সুনাগরিক ও সৎ মানুষ হিসেবে তাই প্রত্যেকেরই ব্রত হওয়া উচিত মাতৃভাষা কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখা । 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *