বাঙালি সংস্কৃতি ও শিল্পকলা

মানুষ যেভাবে জীবন যাপন করে, যেসব জিনিস ব্যবহার করে, যেসব আচার অনুষ্ঠান পালন করে , যা কিছু সৃষ্টি করে , সব নিয়েই তার সংস্কৃতি।

খাদ্য বাসস্থান তেজস্বপত্র যানবাহন পোশাক অলস্কার উৎসব গীতি বাধ্য ভাষা সাহিত্য ধর্মীয় রীতি-নীতি সংগীত নিত্য সবই তার সংস্কৃতির অংশ।

তবুও এর মধ্যে সৃষ্টিশীল কিছু কাজ সংস্কৃতির বিচারে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর সব কাজে একটি জাতির চিন্তাশক্তি ও সৃজনশীল প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়।এগুলোকে আমরা বলি শিল্পকলা।

 

পহেলা বৈশাখ

বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ,১৪ এপ্রিল।  এটি বাঙ্গালীদের প্রাচীন এবং প্রধান সামাজিক উৎসব।

এ উপলক্ষে বিভিন্ন গান বাজনা এবং বৈশাখী মেলা আয়োজন করা হয়। প্রায় সব দেশে সব জনগোষ্ঠী মধ্যে সব সাংস্কৃতিতেই নববর্ষ উদযাপনের প্রথা প্রচলিত আছে।

অবশ্য উদযাপনের রীতি প্রকৃতি ও পদ্ধতি প্রকরণের মধ্যে তারতম্য আছে, তবুও সর্বক্ষেত্রেই একটি মৌলিক ঐক্য আমা দের চোখে পড়ে।

তা হল নবজন্ম বা পূর্ণজন্ম বা পুনরুজ্জীবনের ধারণা পুরানো জীর্ণ এক অস্তিত্বকে বিদায় দিয়ে সতে- জ সজীব নবীন একজীবনের মধ্যে প্রবেশ করার আনন্দানুভুতি। টেনিসন যখন বলেনঃ

রিং আউট দি এন্ড রিং ইন দি নিউ,

রিং হ্যাপি বেলস  এ্যাক্রস দি স্নো ;

দি ইয়ার  ইজ গোয়িং লেট হিম গো

রিং আউট দি কলস রিং ইন দি টু।।

 তখন তার মধ্যে আমরা সেটা লক্ষ্য করি।

কবি রবীন্দ্রনাথ যখন বলেনঃ

 এসো এসো এসো হে বৈশাখ।

  তাপসনিশ্বাসবারে  মুমূর্সরে দাও উড়ায়ে

 বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।।

 যাক পুরাতন স্মৃতি,  যাক ভুলে যাওয়া গীতি

 অশ্রুবাম্প সুদুরে মিলাক

 মুছে যাক গ্লানি মুছে যাক জরা,

 অগ্নিস্নানে সুখী হোক ধরা

 রসের আবেশ রাশি শুষ্ক কবি দাও আসি

 আনো আনো আনো তবুও প্রলয়ের শাখ

 মায়ার কুজঝটিজাল  যাক দূরে যাক।।

 

তখন তার মধ্যে আমরা সেটা লক্ষ্য করি। একজন বলেন কয়লা জানুয়ারিকে উদ্দেশ্য করে আরেকজন লিখেছেন পহেলা বৈশাখকে মনের মধ্যে রেখে, কিন্তু কেন্দ্রীয় ভাবছি উভয় ক্ষেত্রে এক।

পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ বাঙালির এক অন্যান্য উৎসব তার অন্যতম জাতীয় উৎসব।

এর ঐতিহ্য সুপ্রাচীন  ও গৌরবমন্ডিত। আবশ্য  কালের যাত্রাপথ ধরে এক উদযাপন রীতিতে নানা পালা বদল ঘটেছে, বিভিন্ন সময়ে তা বিভিন্ন  মাতৃকতা অর্জন করেছে।

সুদূর অতীতে এর সঙ্গে কৃষি সমাজের যোগসূত্র ছিল অবিচ্ছেদ্য । প্রাচীন কৃষি সমাজের শীতকালীন  নির্জীবতার পর নবজীবনের আবির্ভাবের ধারণার সঙ্গে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের বিষয়টি সম্পর্কিত ছিল।

একথা ভাবা অসঙ্গত নয়। এক সময় গ্রাম নগর নির্বিশেষে বাংলা সব মানুষ সে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ কি খ্রিস্টান হোক বাংলা নববর্ষেরউৎসবে সোৎসাহে যোগ দিত।

পরস্পরের বাড়িতে যাওয়া আসা শুভেচ্ছা বিনিময় খাওয়া-দাওয়া নানা রকম খেলাধুলা ও আনন্দ উৎসব  মেলা ও প্রদর্শনী মিলে সারা বছরের অন্যান্য দিনগুলি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হয়ে এই দিনটি গৌরবন্দিত হয়ে উঠত।

সাড়ে তিনশ বছরের ও বেশি আগে বিখ্যাত ঐতিহাসিক আবুল ফজল তার আইন ই আকবরী গ্রন্থে বাংলা নববর্ষকে এদেশের গণের নওরোজ বলে উল্লেখ্য করেছেন।

অবশ্যই তারও বহু শতবর্ষ আগে থেকে বাংলা মানুষ নানাভাবে এই দিনটি পালন করে আসছে।

কিন্তু পালাবদলের কথা বলছিলাম। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ব্রিটিশ উপনিবেশিক রাজত্বের দিনগুলোর এক পর্যায়ে বাংলা নববর্ষ পালনের মধ্যে এদেশের সুশিত ও শাসিত জনগণের চিত্রের  স্বদেশীকতা ও জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতি ফলন ঘটেছিল।

যদিও সে সময়কার মুসলিম মানসে এর কোনো গভীর বা প্রত্যক্ষ অভিঘাত লক্ষ্য করা যায় না।

বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে অবলম্বন করে তার জাতীয়তাবাদী অনুষঙ্গের সঙ্গে যে সামাজ্যবাদ বিরোধী চেতনা যুক্ত হয়েছিল, একটু লক্ষ্য করলেই তা বোঝা যায়।

১৯৪৭ এ উপমহাদেশ বিভক্তির ফলে পাকিস্তান সৃষ্টির পর সেদিনের পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা নববর্ষ উদযাপন নিয়ে তৎকালীন নয়া উপনিবেশবাদী ক্ষীনদৃষ্টি ধর্মান্ধ পাকিস্তানি শাসক বর্গ যে মনোভাব প্রদর্শন করেন তা একই সঙ্গে কৌতু হলোদ্দীপক ও ন্যক্কারজনক।

তখন এ অঞ্চলের শিক্ষিত মানুষ ধর্ম ও সম্প্রদায় নিরপেক্ষভাবে একটি প্রতিবাদী মনোভাব নিয়ে পরম উৎসাহ ভরে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করেছে।

এর মধ্যে দিয়ে তারা তাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে তুলে ধরেছে, তাদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয় ঘোষণা করেছে, তাদের দীর্ঘদিনের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের প্রতিফলন ঘটিয়েছে।

আজ স্বাধীন বাংলাদেশেও এই দিনটি নানা কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে উৎসব মুখর হয়ে ওঠে। ব্যবসায়ী মহলে হালখাতা ও  মিঠাই বিতরণের অনুষ্ঠান তো আছেই।

তার পাশাপাশি আছে নানা ধরনের ক্রিয়া প্রতিযোগিতা গ্রাম বাংলা ছিল কয়লা বৈশাখের আনন্দ অনুষ্ঠানের প্রাণকেন্দ্র আজ অর্থনৈতিক কারণে শহরে বিশেষভাবে রাজধানী ঢাকায় পহেলা বৈশাখ কে উপলক্ষ করে ।

এখন যে চাঞ্চল্য ও আনন্দ উৎসব দেখা যায় তা নিতান্তই  মেকি একথা বলা যাবে না, কিন্তু তার মধ্যে মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত নাগরিকের বুর্জোয়া বিলাস ও ফ্যাশনের একটি বড় অংশ কাজ করছে সেকথা মানতেই হবে।

পহেলা বৈশাখ কে এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করা প্রয়োজন। বৃহত্তর জনজীবনের সঙ্গে শ্রমজীবী মানুষের আন্তরসত্তার সঙ্গে এর রাকিব বন্ধন কে আবার নতুন করে ভাবতে হবে।

সেই লক্ষ্য আমাদের আজ বাংলা নববর্ষের মধ্যে সচেতন ভাবে নতুন মাতৃকতা যোগ করতে হবে। সাধারণ মানুষের উৎসব এর একান্ত ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র।

যে অত্যন্ত তাৎপর্যময় আজ সেকথাটা আবার জোরে সঙ্গে বলা চাই।

নিজেকে একবার একজন হিন্দু বৌদ্ধ কিংবা খ্রিস্টান ধর্মমম্বি বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে ভেবে দেখুন তাহলেই এর শভিনিস্টিক দিকটি বুঝতে পারবেন। অথচ এ অঞ্চলের ঐতিহ্য তা নয়।

ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী বেনিয়া শক্তির সামনে স্বাধীন বাংলার সূর্য ডুবে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে সিরাজউদ্দৌলা শেষ বারের মত লড়াই করার জন্য ডাক দিয়েছিলেন হিন্দু মুসলমান  উভয়কে।

আমাদের ঐতিহ্য তুমি মদন ও মোহন লালের, তিতুমীর ও মঙ্গল পান্ডের গোবিন্দ দেব ও মনীর চৌধুরীর।

তবে কেন এখন এক এরকম ঘটছে? পাকিস্তানি আমলের ধর্মের নামে নৃশংসতার ইতিহাস ভুলে যাওয়া কি এতই সহজ?

বাঙ্গালী শ্রেষ্ঠ উৎসব বাংলা নববর্ষ  উদযাপন আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাকে পরাজেয়  শক্তি ও মহিমায় পূর্ণ করুক , এই হোক আমাদের শুভ কামনা। জয়  কয়লা বৈশাখ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *