সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচিত “একটি তুলসী গাছের কাহিনী” গল্পটি ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের পরবর্তী সময়ের প্রেক্ষাপটে রচিত। গল্পে, কলকাতা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা একদল মুসলমান যুবক পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) একটি পরিত্যক্ত হিন্দু বাড়ি দখল করে নেয়। তারা বাড়িটিকে তাদের নতুন ঠিকানা হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে।
একদিন, যুবকদের একজন তুলসী গাছটি দেখতে পায়। তুলসী গাছটিকে হিন্দু ধর্মের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। যুবকরা তুলসী গাছটিকে মূলোৎপাটন করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু, তারা গাছটিকে মূলোৎপাটন করতে পারে না। উপরন্তু, তারা গোপনে গোপনে গাছটির যত্ন নেয়।
গল্পের শেষে, পুলিশের হস্তক্ষেপে যুবকদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। তারা নতুন জায়গায় গিয়ে বসবাস শুরু করে। কিন্তু, তুলসী গাছটিকে তারা ফেলে যেতে পারে না। তারা গাছটিকে তাদের সাথে নিয়ে যায়।
গল্পের মূল বিষয়বস্তু হলো ধর্মীয় সহিংসতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা। গল্পে দেখানো হয়েছে, ধর্মীয় সহিংসতা মানুষের জীবনকে কীভাবে ধ্বংস করে দিতে পারে। যুবকরা তুলসী গাছটিকে হিন্দু ধর্মের প্রতীক হিসেবে দেখেছিল। তারা ভেবেছিল, গাছটি তাদের বাড়িতে থাকলে তাদের বাড়ি হিন্দুদের দ্বারা দূষিত হবে। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত তারা বুঝতে পারে যে, ধর্ম কোনও বাড়ি বা মানুষকে দূষিত করতে পারে না।
গল্পটি আরও একটি বিষয় তুলে ধরেছে, তা হলো মানুষের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা। যুবকরা তুলসী গাছটিকে মূলোৎপাটন করতে পারলেও তারা গাছটির প্রতি তাদের ভালোবাসা হারাতে পারেনি। তারা গাছটিকে তাদের সাথে নিয়ে যায়, যাতে তারা তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে পারে।
ধনুকের মতো বাঁকা কংক্রিটের টুলটির পরে বাড়িটা। প্রকাণ্ড বাড়ি। তবে রাস্তা থেকে সরাসরি দন্ডা য়মান।
এদেশে ফুটপাত নাই বলে বাড়িটা একটু জমি ছাড়া ভদ্রতার বালাই নাই। তবে সেটা কিন্তু বাইরের চেহারা। কারণ পেছনে অনেক জায়গা। প্রথমে প্রশস্ত উঠলো।
তারপর পায়খানা গোসলখানা রপরে আম জাম কাঁঠাল গাছে ভরা জঙ্গলের মতো জায়গা।
সেখানে করা সূর্যালোকে ও সূর্যাস্তের স্নান অন্ধকার এবং আগাছায় আদিত্য মাটিতে ভ্যাপসা বন্ধ।আপনার জায়গা যখন তখন সামনে কিছু ছেড়ে একটা বাগান করলে কি দোষ কত? কে কথাই এরা ভাবে।
বিশেষ করে মতিন। তার বাগানের বড় শখ যদিও আজ পর্যন্ত তারকল্পনাতেই পুস্পত হয়েছে।
সেভাবে একটু জমি পেলে সে নিজের বাগানের মত করে নিত। যত্ন করে লাগানো মৌসুমী ফুল গন্ধ রাজ বকুল হাস্নহেনা দু’চারটে গোলাপ ফুল ও।
তারপর সন্ধ্যার পর আপিস ফিরে ফিরে সেখানে বস তো। একটু আরাম করে বসবা জন্য হালকা বেতের চেয়ার বা ক্যানভাসে চেক চেয়ার কিনে নতো।তারপর গা জ্বলে বসে গল্প গুজব করতো।
আমজাদের লহকর অভ্যাস। বাগানের সম্মান বজায় রেখে সে না হয় একটা মানানসই নলগোলা সুদৃশ্য গুড়গুড়ি কিনে নিত।
কাদের গল্পপ-প্রেমিক। ফুরফুরে হাওয়া তার কষ্ট কাহিনীময় হয়ে উঠতো। কিংবা পুষ্প সৌরভে মোদির জ্যোৎস্না রাতে গল্প না করলে বাকি এসে যেতো? এমনিতে চোখ বুজে বসেই নিরবে সান্ধ্যকা লীন স্নিগ্ধতা উপভোগ করত তারা।
আপিস থেকে শ্রান্ত হয়েছে রাস্তা থেকে চলতে থাকা দোতলায় যাবার ভাঙতে ভাঙতে মতিনের মনে জাগে এসব কথা।
বাড়িটা তারা দখল করেছে। অবশ্য লড়াই না করেই; তাদের সামরিক শক্তি অনুমান করে বাড়ির মালিক যে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছিল, তা নয়।
দেশ ভঙ্গের হুজুগে এ শহরে এসে তারা যেমন তেমন একটা ডেরারসন্ধানে উদ্বাস্তু ঘুরছে, তখন একদিন দেখতে পায় বাড়িটা।
সদর দরজায় তালা কিন্তু সামান্য পর্যবেক্ষণের পর বুঝতে পারে বাড়িতে জনমানব নাই এবং তার মালিক দেশ পলাতক।
পরিত্যক্ত বাড়ি চিনতে দেরি হলো না কিন্তু এমন ভারি পাওয়া নিতান্ত সৌভাগ্যর কথা।সৌভাগ্যর আকস্মিকআবির্ভাবে প্রথমে তাদের মনে ভয়ই উপস্থিত হয়। সে ভয়ে কাঁপতে দেরি হয়না।
সেদিন সন্ধ্যায় তারা সদল বলে এসে দরজার তালা ভেঙে বই আওয়াজ তুলে বাড়িটায় প্রবেশ করে। তাদের মধ্যে তখন বৈশাখের আম কুড়ানো ক্ষিপ্র উন্মাদনা বলে ব্যাপারটা তাদের কাছে দিন-দুপুরে ডাকা তির মতো মনে হয় না।
কোন অপরাধে চেতনা যদি বাহা মনে জাগায় প্রয়াস পায়তানি বিজয়ের উল্লাসে নিমেষে তুলোধুনো হয়ে উড়ে যায়।পরদিন শহরে খবরটা ছড়িয়ে পড়লে অনাশ্রিতদের আগমন শুরু হয়।
মাথার উপর একটা ছাদ পাবার আশায় তারা দলে দলে আসে। বিজয়ের উল্লাসে ঢেকে তেরা বলে কি দেখছেন? জায়গা নাই কোথাও। সব ঘরে বিছানায় পড়েছে। এই যে ছোট ভর্তি তাতেও চার-চারটে বিছানা পড়েছে। এখন তো শুধু বিছানা মাত্র।
বারাইপুর চারটি চৌকি এবং দু একটা চেয়ার টেবিলে পা ফেলার জায়গা থাকবেনা। একজন সমবেদ না কন্ঠে বলে, আপনাদের তকলিফ আমরা
কি বুঝি না? একদিন আমরা কি কম কষ্ট পেয়েছি ? তবে আপনাদের কপাল মন্দ। সে হচ্ছে আসল কথা। আপনাদের তকলিফ আমরা কি বুঝি না?
একদিন আমরা কি কম কষ্ট পেয়েছি? যারা হতাশ হয় তাদের মুখ কালো হয়ে ওঠে সময় বেদনা ভরা উক্তিতে। ওই ঘটনা। নিচের তলা রাস্তার ধারে ঘরটা অবশ্য খালি মনে হয়।
খালি দেখালেও খালি নয়। ভাল করে চেয়ে দেখুন। দেয়ালের পাশে শতরঞ্জিতে বাঁধা দুটি বেডিং । শেষ জায়গাটাও দু’ঘণ্টা হলো একাউন্টস এর মোটা বদ্রুদ্দিন নিয়ে নিয়েছে।
শালার কাছ থেকে বিছানাপওর আনতে গেছে। চালাও আবার তার এক দোস্তের বাড়ির বারান্দায় আস্তানা গেড়েছে। পরিবার না থাকলে শালাটি ও এসে হাজির হতো।
নেহাত কপালের কথা। আবার একজনের কন্ঠ সমবেদনায় হল কল করে ওঠে। যদি ঘন্টা দুয়েক আগে আসতেন তবে বুদুর দিনকে বলা দেখাতে পারতেন। ভোটার তেমন আলো নেই বটে কিন্তু দেখুন জানালার পাশে সরকারি আলো।
রাতে কোনদিন ইলেকট্রিসিটি ফেল করলে সেই আলোতেই দিবি চলে যাবে। কিপ্পনতা যদি করতে চায়- অবশ্য এসব পরাহত হতো বাড়ি সন্ধানীদের কানে বিষবৎ হয়।
যথাসময়ে বেআইনি বাড়ি দখলের ব্যাপারটা তদারক করবার জন্য পুলিশ আসে। সেটা স্বাভাবিক। দেশময় একটা ঘোরপরিবর্তনের আলোড়ন বটে কিন্তু কোথাও যে রীতিমতো মগের মুল্লুক করেছে তা নয়।
পুলিশ দেখে তারা ভাবে পলাতক গৃহকর্তারা কি বাড়ি উদ্ধারের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছে? তবে সেকথা বিশ্বাস হয়না দুদিনের মধ্যে বাড়িটা খালি করে দিয়ে সে দেশ থেকে উধাও হয়ে গেছে।
বর্তমানে তার অন্যান্য গভীর সমস্যার কথা ভাববার আছে। সন্দেহ যে পুলিশ পুলিশকে খবর সময় না অন্য প্রাণ নিস নিম্ফলভাবে বাড়ি দখলের ফিখিয়র ছিল।
মন্দ ভাগ্যের কথা মানা যায় কিন্তু সহ্য করা যায় না। ন্যায্য অধিকারস্বত্ব এক কথা অন্য় এর উপর ভাগ্য লাভ অন্য কথা। হিংসার ন্যায় সঙ্গত তো মনে হয়-ই কর্তব্যের বলেও মনে হয় এরা রুখে দাঁড়ায়। আমরা দরিদ্র কেরানি মানুষ বটে কিন্তু সবাই ভদ্র ঘরের ছেলে।
বাড়ি দখল করেছি বটে কিন্তু জানালা-দরজা ভাঙ্গি নাই, ইট পাথর খসিয়ে চোরা বাজারেও চালান করে দেই নাই। আমারও আইন-কানুন বুঝি।
কে নালিশ করছে? সব করে কি এখানে এসে উঠেছি? সদলবলে সাব-ইন্সপেক্টর ভয়েই হয়ত ওপরওয়ালা তা ফাইল চাপা দেয়া প্রেম মনে করে।
অথবা বুঝতে পারে, এই সুযোগে দুর্যোগের সময় অন্য বাড়ি বিষয়ে সরকার টা যেন তেমন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না।
কাদের চোখ টিপে বলে, সত্য কথা দোষ কি? সাব-ইন্সপেক্টরের দ্বিতীয় বউ আমার একরকম আত্মীয়া। বলোনা কাউকে কিন্তু। কথাটা অবশ্য কারোই বিশ্বাস হয় না।
তবে অসত্য টির গোড়ায় যে কেবল একটা নির্মল আনন্দের উস্কানি তা বুঝে তাদেরকে ক্ষমা করতে দ্বিধা হয় না। উৎফুল্ল কন্ঠে কেউ প্রস্তাব করে, কিহে চা মিষ্টিটা হয়ে যাক। রাতারাতি সরগরম হয়ে ওঠে প্রকাণ্ড বাড়িটা।
আস্তানা একটি পেয়েছে এবং চেহারাটি কেউ হাত থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। শুধু এ বিশ্বাসী তার কারণ নয়। খোলামেলা ঝরঝরে টকটকে এবার তাদের মধ্যে একটা নতুন জীবন সঞ্চার করেছে যেন।
এদের অনেকেই কলকাতায় ব্লক মেন লেনে খালাসী পটিতে বৈঠকখানায় দফতরীদের পাড়ায় সৈয়দ সালে লেনে তামাক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বা কম খানসামা লেন-এদুর্গন্ধ নৌকার মধ্যে দিন কাটিয়েছেন।
তুলনায় এবারের বড় বড় কামরা নীলকুঠি দালানের ফ্যাশনে মস্ত মস্ত জানালা খোলামেলা উঠোন আরো পেছনে বন জঙ্গলের মতো আম-জাম-কাঠালের বাগান এসব একটি ভিন্ন দুনিয়া যেন।
এরা লাদেনের মতো একখানা ঘর দখল করেন নাই সত্য তবু এত আলো বাতাস কখনো তারা উপভোগ করে নাই। তাদের জীবনের সবুজ গজাবে ধমনীতে সবল রক্ত আসবে, দুহাজারয়ালাদের মতো মুখে ধোন স্বাস্থ্যের জৌলুস আসবে ম্যালেরিয়া কালাজ্বর ক্ষয় বৃদ্ধি মুক্ত হবে।
রোগাপটকা ইউনুস ইতিমধ্যে তার স্বাস্থ্যের পরিবর্তন দেখতে পায়। সে থাকত ম্যাকলিওড স্ট্রিটে। গলিটা যেন সকালবেলায় আবর্জনা ভরা ডাস্টবিন।
সে গতিতেই নড়বড়ে ধরনের একটা কাঠের দোতলা বাড়িতে রান্না ঘরের পাশে সেতসেতে একটি কছদেশীয় চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চার বছর সেবা করেছে।
পার্টি চামড়ার উৎকট গন্ধে সর্বক্ষণ এমন ভরপুর হয়ে থাকত যে রাস্তার ব্রেনের পচা দুর্গন্ধ পৌছাতো না।
ঘরের কোণে ইদুর বিড়াল মরে থাকলেও তার খবর পাওয়া দুষ্কর দুস্কর ছিল। ইউনূসের লেগে থাকতো, থেকে থেকে শেষ রাতে কাশি ধমক ওঠোতো। পারেনি এ কারণে।
কে তাকে বলেছিল চামড়ার গন্ধ নাকি যক্ষার জীবাণু ধ্বংস করে। দুর্গা তাই সে অম্লানবদনে সহ্য তো করতোই সময় সময় অফিস থেকে ফিরে জানালা পাশে দাঁড়িয়ে পাশের বাড়ির নিশ্ছদ্র দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতো। তাতে অবশ্য তার স্বাস্থ্যের কোন উন্নতি দেখা যায় নাই।
খানাদানা নাহলে বাড়ি শরম হয় না। তাই এক সপ্তাহ ধরে মোগলাই কায়দায় তারা খানাদানা করে। রান্নার ব্যাপারে সকলেই গুপ্ত কেরামতি প্রকাশ পায় সহসা।
নানীর হাঁটতে শেখা বিশেষ পিঠা তৈরির কৌশল শেষ পর্যন্ত অখাদ্য বস্তু তে পরিণত হলেও তাঁরই প্রশংসায় তা মুখরোচক হয়ে ওঠে।
গানের আসর বসে কোন কোন সন্ধ্যায়। হাবিবুল্লাহ কোত্থেকে একটা হারমোনিয়াম নিয়ে এসে তার সাহায্য নিয়ে।
নিজের গলার বলিষ্ঠতার ওপর ভর করে নিশীত রাত পর্যন্ত একটিও অবক্তব্য সঙ্গীত সমস্যা সৃষ্টি করে।
এ সময় একদিন উঠানে প্রান্তে রান্না ঘরের পেছনে চৌকোনা আধ হাত উঁচু ইটের তৈরি একটি মঞ্চের ওপর তুলসী গাছ তাদের দৃষ্টি গতক হয়।
সেদিন রোববার সকাল। নিমের ডাল দিয়ে মেসওয়াক করতে করতে মোদাব্বের উঠোনে পায়চারি করছিল হঠাৎ সে তারস্বরে আর্তনাদ করে ওঠে।
লোকটি এমনিতেই হুজুগে মানুষ। সামান্য কথাতেই প্রান শীতল করা রই রই আওয়াজ তোলার অবস্থা।
তবুও সে আওয়াজ অপেক্ষা করা সহজ নয়। শীঘ্রই কেউ কেউ ছুটে আসে উঠানয়।