বাংলাদেশের অবহেলিত পল্লী জনপদের উন্নয়নের জন্য গৃহীত কর্মসূচির মধ্যে অন্যতম হল কুমিল্লা মডেল বা কুমিল্লা পদ্ধতি।
কুমিল্লা মডেলকে বাংলাদেশের পল্লী উন্নয়নের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করা যায়। কুমিল্লা মডেল বাংলাদেশের অবহেলিত বঞ্চিত দারিদ্র্যপীড়িত নারী-পুরুষের উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে।
গ্রামীণ অবহেলিত জনগণের শিক্ষা ,স্বাস্থ, চিকিৎসা, কৃষি , শিল্পায়ন ছাড়াও আর্থসামাজিক উন্নয়নে কুমিল্লা মডেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
বাংলাদেশে পল্লী উন্নয়নের ক্ষেত্রে গৃহীত কর্মসূচি গুলো বেশিরভাগই ব্যর্থ হয়েছে। এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম হল কুমিল্লা মডেল বা পদ্ধতি। কুমিল্লা মডেল প্রথম ও একমাত্র বাংলাদেশী সংস্থা যারা বাংলাদেশের পল্লী উন্নয়নের ক্ষেত্রে সফল হয়েছে।
কুমিল্লা মডেল বা পদ্ধতি কি
বাংলাদেশের পল্লী উন্নয়নের প্রথম পদক্ষেপ হল V-AID programme কিন্তু V-AID programme সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। আর এ কর্মসূচি ব্যর্থ তার হাত ধরে জন্ম নেয় কুমিল্লা মডেল।
১৯৫৯ পল্লী উন্নয়নের জন্য দুটি স্বয়ওশাসিত প্রতিষঠান চালু করে পাকিস্তান সরকার। এসব প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ছিল পল্লী উন্নয়নের প্রশিক্ষণ প্রদান করা।
এ প্রতিষ্ঠানের একটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কুমিল্লা জেলায় স্থাপিত হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন এর নাম ছিল Pakistan Academy for Village Development (PARID)।
পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লা জেলার কোতোয়ালি থানা কে পল্লী উন্নয়ন গবেষণাগার হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দেয়।
সাথে সাথে একাডেমি ডেনমার্ক, হল্যান্ড, জার্মানি, ফিলিপাইন, প্রভৃতি দেশের পল্লী উন্নয়নের জন্য গৃহীত কার্যক্রম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা করতে থাকে।
এসব দেশের কার্যক্রম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারা এদেশের পল্লী উন্নয়নের জন্য একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করে। নতুন উদ্ভাবিত এ পদ্ধতি কুমিল্লা পদ্ধতি বা কুমিল্লা মডেল নামে পরিচিত পায়।
BARDএর প্রতিষ্ঠাতা ডক্টর আখতার হামিদ খান এর মতে কুমিল্লা পদ্ধতি হচ্ছে সমম্বিত ও পরস্পর সহায়ক দল গত কার্যবলি দ্বারা গ্রাম উন্নয়নের প্রচেষ্টা যাতে সরকারী কর্মচারীকে বিকল্পনাবিন,নির্বাহ ও তত্ত্বাবধায়কের নতুন ভূমিকায় উপস্থাপিত করা, কার্যকর স্বয়ওশাসিত প্রতিষঠান গড়ে তোলা অধিক শস্য প্রাপ্তি কৃষিদ্রব্যর উচ্চমূল্য প্রদান, বন্যায় ক্ষয় ক্ষতি র নিরোধ, গ্রাম অঞ্চলে রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো।
বৈশিষ্ট্যঃ
কুমিল্লা মডেলের নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যথাঃ
▦ দ্বিস্তরবিশিষ্ট সমবায়।
▦ স্থানীয় নেতৃত্বের বিকাশ ও উন্নয়ন।
▦ স্থানীয় নেতৃত্বের মাধ্যমে স্থানীয় সংগঠন করে তোলা।
▦ কর্মসূচির সুষ্ঠু তদারকি করা।
▦ সমবায়ী সদস্যদের মধ্যে নিয়তি যোগাযোগ ও তাদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করা।
▦ সর্বক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক নীতি অনুসরণ।
▦ কৃষকদের সহজে ঋণদান ও কৃষি উপকরণ সরবরাহ করা।
▦ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষকদের পরামর্শ দান করা।
▦ গ্রামীণ জনগণকে কৃষি ও সামাজিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ দান।
▦ কৃষকদের মূলধন গঠনে সহায়তা করা।
▦ কৃষকদের সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করা।
▦ পল্লী নারীদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য গার্হস্থ্য উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা।
কুমিল্লা মডেল এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
কুমিল্লা মডেল এর প্রতি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল নিম্নরূপঃঅসংগঠিত গ্রামবাসীকে সংঘটিত করা ও তাদের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হতে সাহায্য করা।
গ্রামীণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ , গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন ও আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা।
- স্থানীয় স্বয়ওশাসিত প্রতিষঠান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ মহিলাদের উন্নয়ন সাধন।
- গ্রামীণ কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণ যাতে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পায়।
- প্রতিটি থানাকে গ্রাম উন্নয়নের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা।
কুমিল্লা মডেল এর উপাদান সমূহঃ
পল্লী উন্নয়নের জন্য কুমিল্লা মডেল চারটি উপাদান হল।
➊ দ্বিস্তরবিশিষ্ট সমবায় সমিতি (Two tiet co-operative system)
➋ পল্লীপূর্ত কর্মসূচি (Rural works programme)
➌ থানা সেচ প্রকল্প (Thana irrigation project)
➍ রান্না প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কেন্দ্র (Than training and development center)
দ্বিস্তরবিশিষ্ট সমবায় সমিতি (Two tier co-operative system)
১৯৬১ সালেআখতার হামিদ খান কুমিল্লা মডেল এর মাধ্যমে দ্বিস্তরবিশিষ্ট সমবায় পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন।
এ সমবায় সংগঠন জার্মানি রাইদেজন পদ্ধতির সমবায় ও ডেনমার্কের লোক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে গঠিত হয়।
গ্রামের লোকেদের মধ্যে সঞ্চয় মনোভাব গড়ে তোলা সংঘটিত করা মূলধন গঠন জমিতে উন্নয়ন প্রযুক্তির প্রয়োগ ইত্যাদি ছিল সমবায় সমিতি গঠনের মূল লক্ষ্য।
দু ধরনের সমবায় সমিতির নিয়ে দ্বিস্তরবিশিষ্ট সমবায় সমিতি গঠিত ছিল। যথাঃ
❒ কৃষক সমবায় সমিতি (KSS)
❒ থানা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি (TCCA)
গ্রাম ভিত্তিক সমবায় সংগঠন হলো কৃষক সমবায় সমিতি। এ সময়টিতে প্রধান হতেন ম্যানেজার। কৃষক নিয়ে এ সমিতি লোহিত হতো। গ্রামীণ কৃষকদের উন্নয়ন ও উৎপাদন বৃদ্ধি করায় ছিল সমবায় সমিতির মূল কাজ।
গ্রাম পর্যায়ের সমিতি গুলোকে সব ধরনের সহায়তা গানের জন্য থানা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি গড়ে তোলা হতো। গ্রাম সমবায় ছবিগুলোকে প্রশিক্ষণ দান সম্পর্কে জ্ঞান দান করেছিল কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির উদ্দেশ্য।
এছাড়া ও কৃষক সমবায় সমিতিগুলোকে উন্নত কৃষি উপকরণাদি সরবরাহ করত কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি। মূলত KSS এবং TCCA পরস্পর নির্ভরশীল দুটি সংস্থা। দ্বিস্তরবিশিষ্ট সমবায় সমিতি অর্থনীতি উন্নতির সহায়ক।