মাউন্ট এভারেস্ট বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এবং এটি নেপাল এবং চীনের তিব্বত অঞ্চলের সীমানায় অবস্থিত।
মাউন্ট এভারেস্ট উচ্চতা ৮,৮৪৮.৮৬ মিটার (২৯,০৩১.৭ ফুট) এবং এটি হিমালয় পর্বতমালার একটি অংশ। এই পর্বতশৃঙ্গকে স্থানীয়ভাবে নেপালে“সাগরমাথা” এবং তিব্বতে “চোমোলুংমা” বলা হয়, যার অর্থ “বিশ্বের দেবী”। এখানে মাউন্ট এভারেস্ট সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হলো।
মাউন্ট এভারেস্ট তিব্বতে কি নামে পরিচিত?
মাউন্ট এভারেস্টের ভৌগোলিক অবস্থান
মাউন্ট এভারেস্ট ২৭°৫৯′ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৬°৫৫′ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। এটি হিমালয় পর্বতমালার মহালাংগুর অংশে অবস্থিত। নেপাল এবং চীনের তিব্বত অঞ্চলের সীমান্তে অবস্থিত হওয়ায় এটি দুটি দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
মাউন্ট এভারেস্টের নামকরণ
- ইংরেজি নাম: ব্রিটিশ ভূ-পরিমাপক স্যার জর্জ এভারেস্টের নামানুসারে এই পর্বতের নামকরণ করা হয়। ১৮৫৬ সালে, অ্যান্ড্রু ওয়াহ নামে এক ব্রিটিশ ভূ-পরিমাপক প্রথম এভারেস্টের উচ্চতা পরিমাপ করেন এবং এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ বলে চিহ্নিত করেন।
- স্থানীয় নাম: নেপালে এটি “সাগরমাথা” নামে পরিচিত, যার অর্থ “স্বর্গের মাথা।” তিব্বতে এটিকে “চোমোলুংমা” বলা হয়, যার অর্থ “মহান দেবীর মা।”
এভারেস্টের আবিষ্কার এবং পরিমাপ
১৮৫৬ সালে ব্রিটিশ সার্ভে অফ ইন্ডিয়া প্রথম মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা ৮,৮৪০ মিটার বলে ঘোষণা করে। পরবর্তীতে প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে এর উচ্চতা পুনর্মূল্যায়ন করা হয়। ২০২০ সালে চীন ও নেপাল যৌথভাবে এর উচ্চতা পুনরায় পরিমাপ করে, যা এখন ৮,৮৪৮.৮৬ মিটার হিসাবে গৃহীত হয়েছে।
আরোহন ইতিহাস
- প্রথম আরোহন: ১৯৫৩ সালের ২৯ মে স্যার এডমুন্ড হিলারি (নিউজিল্যান্ড) এবং তেনজিং নোরগে (নেপাল) প্রথম সফলভাবে মাউন্ট এভারেস্টে আরোহণ করেন। এটি ছিল ইতিহাসে একটি বড় অর্জন।
- নারীদের আরোহন: ১৯৭৫ সালে, জুনকো তাবেই প্রথম নারী হিসেবে এভারেস্ট জয় করেন।
- বেশি বার আরোহন: নেপালি শেরপা কামি রিতা শেরপা ২৬ বারেরও বেশি এভারেস্ট জয় করেছেন, যা একটি রেকর্ড।
মাউন্ট এভারেস্ট আরোহনের চ্যালেঞ্জ
এভারেস্ট জয় করা অত্যন্ত কঠিন এবং বিপজ্জনক। এখানে কিছু প্রধান চ্যালেঞ্জের কথা বলা হলো:
অক্সিজেনের অভাব: উচ্চতার কারণে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকে। তাই আরোহীদের সাথে অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখতে হয়।
প্রচণ্ড ঠান্ডা: তাপমাত্রা সাধারণত শূন্যের নিচে থাকে এবং শক্তিশালী বাতাস আরোহনের সময় বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
অবস্থানগত বিপদ: তুষারধ্বস (অ্যাভালাঞ্চ) এবং বরফ ফাটার ঝুঁকি থাকে।
শারীরিক ক্লান্তি: দীর্ঘ সময় ধরে আরোহণের ফলে শারীরিক এবং মানসিক ক্লান্তি হয়।
মাউন্ট এভারেস্টের পরিবেশগত প্রভাব
মাউন্ট এভারেস্ট একটি অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ হলেও পর্যটন ও অভিযাত্রার কারণে এর পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্লাস্টিক বর্জ্য, অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং পরিত্যক্ত সরঞ্জামের ফলে দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মাউন্ট এভারেস্টে অভিযাত্রা
বর্তমানে, নেপাল এবং চীন উভয় দেশই এভারেস্টে আরোহণের অনুমতি প্রদান করে। নেপালের দিকটি তুলনামূলক জনপ্রিয় কারণ এটি আরোহনের জন্য সহজ এবং অভিযাত্রীদের জন্য আরও ভালো সেবা প্রদান করে। তবে, এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং বিপজ্জনক একটি কার্যক্রম।
মাউন্ট এভারেস্টের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
এভারেস্ট পর্যটনের মাধ্যমে নেপাল এবং চীন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রাজস্ব অর্জন করে। প্রতিবছর হাজার হাজার অভিযাত্রী এবং পর্যটক এভারেস্ট দেখতে এবং আরোহণ করতে আসে। এর ফলে স্থানীয় অর্থনীতিতে একটি বড় ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে কত সময় লাগে?
মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় উঠা একটি অত্যন্ত জটিল ও বিপদসংকুল প্রক্রিয়া। এটি শুধু শারীরিক দক্ষতা নয়, মানসিক প্রস্তুতি, অভিজ্ঞতা, এবং পরিবেশগত পরিস্থিতির ওপরও নির্ভর করে। মাউন্ট এভারেস্টে চূড়ায় উঠার সময়কাল বিভিন্ন ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভরশীল। নিচে এই বিষয়ে একটি বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরা হলো:
সময়কাল নির্ধারণকারী ফ্যাক্টরসমূহ
মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে সময়কাল নির্ধারণ করে কিছু প্রধান ফ্যাক্টর:
মৌসুম:
এভারেস্ট আরোহণ সাধারণত দুইটি মৌসুমে ঘটে—প্রী-মনসুন (এপ্রিল থেকে জুন) এবং পোস্ট-মনসুন (সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর)। প্রাক-মনসুন মৌসুমে আবহাওয়া তুলনামূলক ভালো থাকে, তাই এই সময়টিতে আরোহণকারীদের সংখ্যা বেশি।
অভিজ্ঞতা ও প্রস্তুতি:
একটি অভিজ্ঞ দলের তুলনায় নতুনদের জন্য আরোহণে বেশি সময় লাগে। শারীরিক ফিটনেস, উচ্চতাজনিত রোগের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা এবং আরোহণ দক্ষতা এই প্রক্রিয়ার সময়কে প্রভাবিত করে।
রুট ও স্টেজ:
মাউন্ট এভারেস্টে আরোহণে সাধারণত দুটি প্রধান রুট ব্যবহার হয়—দক্ষিণ রুট (নেপাল) এবং উত্তর রুট (তিব্বত)। দক্ষিণ রুট তুলনামূলক সহজ এবং জনপ্রিয়। পুরো যাত্রা সাধারণত কয়েকটি স্টেজে বিভক্ত থাকে:
- বেস ক্যাম্প পৌঁছানো (৭-১০ দিন):
নেপালের লুকলা থেকে ট্রেকিং করে এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে পৌঁছাতে ৭-১০ দিন লাগে। এই সময়টিতে আরোহণকারীরা উচ্চতা এবং কম অক্সিজেনের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেন।
- বেস ক্যাম্প থেকে সামিট (৪০-৫৫ দিন):
বেস ক্যাম্প থেকে চূড়ায় উঠতে এবং ফিরে আসতে সাধারণত ৪০ থেকে ৫৫ দিন সময় লাগে।
- বেস ক্যাম্প পৌঁছানো (৭-১০ দিন):
সুনির্দিষ্ট সময়সীমা
মাউন্ট এভারেস্টে উঠার পুরো প্রক্রিয়া সাধারণত দুই মাস সময় নেয়। নিচে পুরো যাত্রার ধাপগুলো উল্লেখ করা হলো:
অ্যাক্লিমাটাইজেশন (২-৩ সপ্তাহ):
উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন ক্যাম্পে কয়েকবার যাতায়াত করতে হয়। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ উচ্চ উচ্চতায় অক্সিজেনের ঘাটতি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
সম্ভাব্য আবহাওয়ার অপেক্ষা (১-২ সপ্তাহ):
সামিট ডে’র আগে আরোহণকারীরা এক উপযুক্ত “ওয়েদার উইন্ডো”র জন্য অপেক্ষা করেন। এই সময় আবহাওয়া স্থিতিশীল থাকে এবং চূড়ায় ওঠার জন্য নিরাপদ।
সামিট ডে (১২-২০ ঘণ্টা):
চূড়ায় উঠতে সাধারণত ৮-১২ ঘণ্টা এবং নামতে আরও ৪-৮ ঘণ্টা লাগে। এই দিনটি অত্যন্ত ক্লান্তিকর ও বিপজ্জনক।
অরুণ নদীর অববাহিকা- ছবি:শাটারস্টক
মাউন্ট এভারেস্ট আরোহণের সময় যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়:
অক্সিজেনের অভাব:
চূড়ার কাছাকাছি “ডেথ জোন” (৮,০০০ মিটারের ওপরে) অক্সিজেনের মাত্রা খুব কম থাকে, যা জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ।
অপ্রত্যাশিত আবহাওয়া:
হঠাৎ ঝড় বা তুষারপাতের কারণে সময়সীমা বৃদ্ধি পেতে পারে।
শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি:
দীর্ঘ সময় ধরে কঠিন পরিশ্রম করার ফলে শরীর ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।
বাংলাদেশের প্রথম মাউন্ট এভারেস্ট আরোহী কে?
উপসংহার
মাউন্ট এভারেস্ট শুধুমাত্র একটি পর্বত নয়; এটি মানবজাতির চরম প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে জয়ের প্রতীক। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং দুঃসাহসিক অভিযানের ইতিহাস মানুষের মনে অমর হয়ে থাকবে। তবে, এটি রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। পরিবেশ সচেতনতা ও নিরাপত্তার দিকে নজর রেখে আমরা এই প্রাকৃতিক বিস্ময়কে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুরক্ষিত রাখতে পারি।
আরও পড়ুন