আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রেক্ষাপট ও রচনা

ভাষা আন্দোলন

হাজার 1947 সালে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ব্রিটিশ ভারত ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের  উদ্ভব হয়।

পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তান প্রায় 2 হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও ও ভাষাগত দিক থেকে অনেক গুলো মৌলিক পার্থক্য ছিল, সমগ্র পাকিস্তানের শতকরা 56 ভাগ মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা।

1947 সালের 23 শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের বৈঠকে ইংরেজি ও উর্দু ভাষা ব্যবহারের পাশাপাশি বাংলা ভাষা ব্যবহারের অধিকার সংক্রান্ত এক সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন পূর্ব বাংলা থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ।

প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এ প্রস্তাবের কঠোর সমালোচনা করেন । ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশোধনী প্রস্তাব গৃহীত হয়নি । বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে গড়ে ওঠে  তমদ্দুন মজলিস ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।

হাজার 947 সালের 10 ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায়  বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ধর্মঘট ডাকা সিদ্ধান্ত হয় ।

11 ই মার্চ পালিত সেই ধর্মঘট পিকেটিংয়ের সময় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছিল । এর কিছুদিন পরে একুশে মাছ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ধাকা এক ভাষণে ঘোষণা করেন।

উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা । 24 শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে গিয়েও তিনি একই বক্তব্য রাখেন।

যখন তিনি উর্দু ব্যাপারে তার অবস্থানের কথা পুনর উল্লেখ্য করেন উপস্থিত ছাত্ররা  শমপদ ধরে নানা বলে চিৎকার করে ওঠে।

তাৎক্ষণিকভাবে এ ঘোষণার প্রতিবাদে তারা বলে উর্দু নয় বাংলা হও হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ।

পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় বাংলা ভাষা মর্যাদায় দায়িত্ব পূর্ব বাংলায় আন্দোলন  ছোট দানা বেঁধে ওঠে।

ভাষা আন্দোলনের আদি কথা

হাজার 952 সালে 27 শে জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন আবারো উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন ।

এর ফলে পূর্ববাংলা জনগণকে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে’ । 29 শে জানুয়ারি সিদ্ধান্ত হয় ঢাকা শহরে প্রতিবাদী মিছিল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে’। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আন্দোলনকারী সংগঠনগুলোর সম্মিলিতভাবে। 

একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে সমগ্র পূর্ব বাংলায় প্রতিবাদ কর্মসূচি ও ধর্মঘটের  আহ্বান করে । আন্দোলন দমন করতে পুলিশ 144 ধারা জারি করে ।

ফলে দিনটিতে ঢাকা শহরের সকল প্রকার মিছিল-সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষিত হ… কিন্তু এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুসংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন।

একুশের স্মৃতি

হাজার 952 সালে একুশে ফেব্রুয়ারি পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী সকাল 9 টা থেকে সরকারি আদেশ অপেক্ষা করে ঢাকা শহরে স্কুল-কলেজের হাজার হাজার ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হয় ।

144 ধারা ভঙ্গের প্রশ্নে পুরাতন কলা ভবনের আমতলার ঐতিহাসিক ছাত্রসভায়  অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্ররা 57 জন করে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগান দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে আসতে চায়।

তারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে স্লোগান দিতে  থাকে । পুলিশ অস্ত্রহাতে সবাই চারদিক ঘিরে রাখে ।

বেলা সোয়া এগারটার দিকে ছাত্ররা একত্র হয়ে প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে ছাত্রদের সতর্ক করে  দেয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তখন পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ বন্ধ করতে অনুরোধ জানান এবং ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ত্যাগের নির্দেশ দেন।

কিন্তু ক্যাম্পাস ট্যাগ করার সময় কয়েকজন ছাত্রকে 144 ধারা ভঙ্গের অভিযোগে পুলিশ গ্রেফতার করলে সহিংসতা  ছড়িয়ে পড়ে । এরপর আরো অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয় ।

এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল বের  করে। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ কাছাকাছি এলে পুলিশ 144 ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে ।

গুলিতে নিহত হয় রফিক সালাম  বরকত জব্বার সহ আরো অনেকে । শহীদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে’ শোকাবহ এ ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে।

রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি  অর্জন

অন 952 সালে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলন ভাষা কেন্দ্রীয় হলেও তা পুরো বাঙালি জাতির অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে ।

এর ফল হিসেবে 1954 সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল ব্যবধানে মুসলিম লীগ কে পরাজিত করে । একুশের চেতনাকে ধারণ করে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনি ইশতেহার ছিল 21 দফা  সংবলিত।

ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে 954 সালে সাথী মেয়ে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়।

হাজার 955 সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার জন্য বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হ… হাজার 956 সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান বাংলা উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয় ।

হাজার 999 সালের 7 ডিসেম্বর বাংলা ভাষা আন্দোলন মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যা বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযথ মর্যাদায় উদযাপিত হয়।

আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করতে কানাডাপ্রবাসী রফিকুল ইসলাম ওয়াজ আব্দুস সালাম উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন’।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রধান তাৎপর্য এই যে বাঙালি জাতি তার জাতীয়তাবোধ ও অধিকার সম্পর্কে প্রথম সচেতন হয় । ভাষার প্রশ্নে সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল ।

এর ফলে পূর্ববাংলা গড়ে ওঠে একটি সচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণি । এরপর যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে তার পিছনের কাজ করেছে ভাষা আন্দোলন উজ্জ্বল স্মৃতি ।

ভাষা আন্দো- লনের প্রেরণায় হাজার 962 শিক্ষা আন্দোলন হাজার 966 6 দফা এবং হাজার 900 69 এর গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে 1971 সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জিত হয়েছে। এখনো সেই লক্ষ্য পুরোপুরি বাস্তবায়িত  হয়নি। 

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে কবিতা

ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ, দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়! বরকতের রক্ত
হাজার যুগের সূর্যতাপে, জ্বলবে এমন লাল যে
সেই লোহিতেই লাল হয়েছে, কৃষ্ণচূরার ডাল যে
প্রভাতফেরির মিছিল যাবে, ছড়াও ফুলের বন্যা
বিষাদগীতি গাইছে পথে, তিতুমিরের কন্যা
চিনতে নাকি সোনার ছেলে, ক্ষুদিরামকে চিনতে?
রিদ্ধস্বাশে প্রাণ দিল যে, মুক্ত বাতাস কিনতে
পাহাড়তলীর মরণ চূরায়, ঝাঁপ দিলো যে অগ্নী
ফেব্রুয়ারীর শোকের বসন, পড়ল তারই ভগ্নী
প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী, আমায় নেবে সঙ্গে?

মহাসমুদ্রের শতবতশরের কল্লল
কেহ যদি এমন করিয়া বাধিয়া রাখিতে পারিতো
যেন সে ঘুমন্ত শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত।
তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই কারাগাড়ের তুলনা হইতো।
এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে!, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে,
মানব আত্বার অমর আলোক
কালো অক্ষরের সৃঙ্খলে কাগজের কারাগাড়ে বাধা পড়িয়া আছে!

উপসংহারঃ

কেবল বাংলা ভাষাকে নয়, পৃথিবীর সকল ভাষার নিজস্ব মহিমা অক্ষুন্ন রাখার দীপ্ত শপথ নেবার দিন হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারি- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাঙালি হিসেবে আজ আমাদের সবার অঙ্গীকার সর্বস্তরে বাংলা-ভাষার প্রচার ও প্রসার।