রোহিঙ্গা সমস্যা কি
রোহিঙ্গা সমস্যা হল মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও বৈষম্যের একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত, এবং তারা দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্যের শিকার হয়েছে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও নির্যাতনের একটি ভয়াবহ অভিযান চালায়। এই অভিযানের ফলে প্রায় ৭০০,০০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
রোহিঙ্গা সমস্যা একটি জটিল সমস্যা যা মিয়ানমারের জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দীর্ঘ ইতিহাসের প্রতিফলন। সমস্যার সমাধানের জন্য মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান, তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করা এবং তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমার সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করতে পারে যাতে তারা রোহিঙ্গাদের সমস্যার সমাধানে পদক্ষেপ নেয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা প্রদানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
রোহিঙ্গারা কোথাকার
রোহিঙ্গারা পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অধিবাসী। তারা একটি ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠী যারা ঐতিহাসিকভাবে রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছে। রোহিঙ্গারা মুসলিম ধর্মের অনুসারী।
রোহিঙ্গাদের জাতিগত পরিচয় নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের “অবাঙালি” বলে বিবেচনা করে এবং তাদেরকে নাগরিকত্ব দেয় না। তবে, রোহিঙ্গারা নিজেদের রাখাইন রাজ্যের আদিবাসী হিসেবে বিবেচনা করে।
রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরে নাগরিকত্ব ও অন্যান্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও নির্যাতনের একটি ভয়াবহ অভিযান চালায়। এই অভিযানের ফলে প্রায় ৭০০,০০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
বর্তমানে, প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশে বাস্তুচ্যুত অবস্থায় রয়েছে।
রোহিঙ্গা সংকট কবে শুরু হয়
রোহিঙ্গা সংকটকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা হয়:
- দীর্ঘমেয়াদী সংকট: রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে দীর্ঘদিন ধরে নাগরিকত্ব ও অন্যান্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। এই দীর্ঘমেয়াদী সংকট ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই শুরু হয়।
- সংকটপূর্ণ দ্রুতগতিসম্পন্ন প্রস্থান: ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করে। এই নির্যাতনের ফলে প্রায় ৭০০,০০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
সুতরাং, রোহিঙ্গা সংকটকে যদি দীর্ঘমেয়াদী সংকট হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে এর সূচনা ১৯৪৮ সালের দিকে বলা যেতে পারে। তবে, সংকটপূর্ণ দ্রুতগতিসম্পন্ন প্রস্থানের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে, এর সূচনা ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে বলা যেতে পারে।
২০১৭ সালের আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এই রোহিঙ্গারা এখনও বাংলাদেশে অনিরাপদ অবস্থায় বসবাস করছে। তাদের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
ভাসান চরে কতজন রোহিঙ্গা আছে
২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসের ৩০ তারিখ পর্যন্ত ভাসান চরে প্রায় ১৮,৩৪৭ জন রোহিঙ্গা বসবাস করছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে ১ হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গাকে কক্সবাজার থেকে ভাসানচর স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে এখানে রোহিঙ্গাদের বসবাস শুরু হয়। এরপর থেকে বিভিন্ন ধাপে মোট ১৮,৩৪৭ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে।
ভাসানচর বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলায় অবস্থিত একটি চর। এই চরে এক লাখ রোহিঙ্গার ধারণক্ষমতার আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
কেন রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ছাড়ছে
রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ছাড়ছে মূলত নিম্নলিখিত কারণে:
- নাগরিকত্ব ও অন্যান্য অধিকার থেকে বঞ্চিত: মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরে নাগরিকত্ব ও অন্যান্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদেরকে “অবাঙালি” বলে বিবেচনা করে এবং তাদেরকে নাগরিকত্ব দেয় না। ফলে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে শিক্ষা, চাকরি, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি সামাজিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়।
- নির্যাতন ও নিপীড়ন: মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতন ও নিপীড়ন চালিয়ে আসছে। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করে। এই নির্যাতনের ফলে প্রায় ৭০০,০০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
- অনিশ্চয়তা ও ভয়: মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তারা জানে না যে তারা কখনও মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারবে কিনা। এই অনিশ্চয়তা ও ভয়ের কারণে তারা মিয়ানমার ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
রোহিঙ্গা সংকট একটি জটিল সমস্যা। এর সমাধানের জন্য মিয়ানমার সরকারের সাথে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যৌথ প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
২০১৭ সালে কতজন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে
২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও নির্যাতন চালানো হয়। এই নির্যাতনের ফলে প্রায় ৭০০,০০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের (ইউএনএইচসিআর) একটি অনুমান অনুসারে, ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে প্রায় ১০,০০০ রোহিঙ্গা নিহত হয়। তবে এই সংখ্যাটি আরও বেশি হতে পারে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন।
ইউএনএইচসিআর-এর অনুমান ছাড়াও, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা নিহতের সংখ্যার বিভিন্ন অনুমান দিয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকান সেন্টার ফর রিসার্চ অন ইন্টারন্যাশনাল লেবার (সিআরআইএল) অনুমান করে যে ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে প্রায় ২৭,০০০ রোহিঙ্গা নিহত হয়। অন্যদিকে,
ব্রিটিশ মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অনুমান করে যে ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে প্রায় ৬,৭০০ রোহিঙ্গা নিহত হয়।
২০১৭ সালে রোহিঙ্গা নিহতের সংখ্যা নির্ধারণ করা একটি কঠিন কাজ। কারণ, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের মৃত্যুর সংখ্যা গোপন করে আসছে। এছাড়াও, অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আসার পর তাদের পরিবারের সদস্যদের নিহতের খবর জানতে পেরেছে। ফলে, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা নিহতের সঠিক সংখ্যা জানা সম্ভব হয়নি।
ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের নতুন জীবন শুরু
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও নির্যাতনের একটি ভয়াবহ অভিযান চালায়। এই অভিযানের ফলে প্রায় ৭০০,০০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজারে আশ্রয় শিবির তৈরি করে। তবে, এই আশ্রয় শিবিরগুলিতে রোহিঙ্গারা ঘনবসতিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করতে বাধ্য হয় এবং তাদের জীবনযাত্রার মান খুবই নিম্ন।
এই পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে একটি নতুন রোহিঙ্গা আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। ভাসানচর একটি নতুন দ্বীপ যা নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার অন্তর্গত। এই প্রকল্পের আওতায় ১ লাখ রোহিঙ্গার জন্য আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।
২০২২ সালের ১৫ জুলাই প্রথম দফায় ১ হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর করা হচ্ছে।
ভাসানচরে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গারা তাদের নতুন জীবন শুরু করতে শুরু করেছে। তারা নতুন আবাসনে বসবাস করছে, তাদের সন্তানদের জন্য স্কুলে ভর্তি করছে এবং বিভিন্ন ধরনের কাজের মাধ্যমে আয়ের ব্যবস্থা করছে।
রোহিঙ্গাদের নতুন জীবন শুরুর কিছু ইতিবাচক দিক হল:
- তারা ঘনবসতিপূর্ণ অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়েছে এবং আরও স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করতে পারছে।
- তাদের সন্তানদের জন্য ভালো শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে।
- বিভিন্ন ধরনের কাজের মাধ্যমে আয়ের ব্যবস্থা করতে পারছে।
তবে, রোহিঙ্গাদের নতুন জীবন শুরুর কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:
- তাদের নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সময় লাগবে।
- তাদের মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে তাদের পুনর্বাসনে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।
- মিয়ানমারে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে তারা স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বসবাস করতে পারবে না।
পরিশেষে, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের নতুন জীবন শুরু একটি ইতিবাচক প্রক্রিয়া। তবে, এই প্রক্রিয়াকে আরও সফল করতে হলে রোহিঙ্গাদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে এবং মিয়ানমারে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা প্রয়োজন।