বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকটের নানা দিক ধারণ করেছে । মূল কারণগুলো হচ্ছে চাহিদার তুলনায় কম উৎপাদন । বাংলাদেশে বর্তমানে পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ৫ শতাংশ প্রবৃত্তি হলে ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন ।
১০ বছর ধরে সরকার এটি জেনেও উৎপাদন মাত্র ৩ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটে সীমাবদ্ধ রেখেছে ।
পৃথিবীতে যেদিন থেকে মানুষ আগুনের ব্যবহার শুরু করে সেদিন থেকেই জ্বালানি হয়ে ওঠে উন্নয়নের চাবিকাঠি । স্যার জগদীশচন্দ্র বসু বলেছিলেন যে , মানুষের মৌলিক চাহিদা হলো উন্নত ,বস্তু , বাসস্থান ও জ্বালানি ।
যখন টমাস আলভা এডিসনের বৈদ্যুতিক বাল নিউইয়র্ক শহর আলোকিত করে , তখন থেকেই বিদ্যুৎ হয়ে ওঠে উৎপাদনের মূল চালিকাশক্তি । পৃথিবীতে শিল্পবিপ্লব ও কৃষিবিপ্লব সম্ভব হয় বিদ্যুতের দ্বারাই ।
রাতের অন্ধকারে একজন মানুষ প্লেনে যাত্রাকালে যদি জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকায়, তাহলে সে আলোকসজ্জা দেখেই বুঝতে পারে যে , সে শহরের ওপর দিয়ে যাচ্ছে না গ্রামের উপর দিয়ে যাচ্ছে ।
ধনী দেশের ওপর দিয়ে যাচ্ছে না আদিম অসভ্য অনুগ্রসর , অনুন্নত গরিব দেশের উপর দিয়ে যাচ্ছে ।
বর্তমান বিশ্ব ও বিদ্যুৎ ব্যবহারঃ বিদ্যুৎ বর্তমান বিশ্ব সভ্যতার একটি অবিচ্ছেদ ও অপরিহার্য অংশ । বিদ্যুৎ ছাড়া বর্তমান বিশ্ব সভ্যতার একটি মুহূর্ত বা কোনো কিছুই কল্পনা করা যায় না । বর্তমানে বিজ্ঞানের অগ্রগতি হচ্ছে অতি দ্রুতগতিতে ।
এ দ্রুতগতি বলা যায় বিজ্ঞানের জাদুর স্পর্শের জন্যই সম্ভব হচ্ছে । বিশ্বের উন্নত শিল্পপ্রধান দেশগুলোর মূল চালিকাশক্তিই হচ্ছে বিদ্যুৎ । লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে , দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দুটো উন্নয়ন হচ্ছে ভারত এবং চীনে ।
সম্প্রতিক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভারতের সাথে এক যুগান্তকারী চুক্তি সম্পাদন করেন । এর দ্বারা ভারত হয়ত আগামী ১০ বছরে আণবিক শক্তি দ্বারা কম খরচে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হবে ।
ভারত ভুটানের সাথেও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জলবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প করেছে , যা আগামী পাঁচ বছরের ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অতিকম মূল্য ভারতকে দেবে ।
আর তার আশীর্বাদে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত শিল্প ও কৃষি বিপ্লব ঘটিয়ে উঠে যাবে সফলতার সুউচ্চ শিখরে । কিন্তু আমাদের দেশে বিদ্যুতের এত বেশি চাহিদা থাকা সত্বেও সরকার তেমন কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না ।
বর্তমানে শহর বন্দরের পরিধি বাড়ছে সংখ্যা ও বাড়ছে । আর সেই সাথে বাড়ছে নতুন নতুন শিল্প কারখানা ও ব্যবসায় কেন্দ্র । এগুলো সবই হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রিক ।
তাছাড়া গ্রামগঞ্জেও এখন শুরু হয়েছে বিদ্যুতের অবাধ ব্যবহার । কৃষি ক্ষেত্রেও এখন হয়ে পড়েছে বিদ্যুৎনির্ভর । এক কথায় বর্তমান বিশ্ব প্রতিপদে প্রতিমুহূর্তে বিদ্যুতের ওপর একান্ত ভাবে নির্ভরশীল ।
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকটের কারণ
যথা-
(ক) অবৈধ ও অসাধু উপায়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার ।
(খ) সিস্টেম লস বা বিদ্যুৎ বিবর্তনের ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতি ।
(গ) অপচয় ও অসচেতনতা
এগুলো ছাড়া ও আমাদের দেশের বিদ্যুৎ সংকটের মূলে রয়েছে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির প্রবণতা । আমাদের দেশের কলকারখানা; নগরের ব্যবসাকেন্দ্র , মার্কেট , শপিংমল অফিস আদালতসহ গ্রামের কৃষি ক্ষেত্রে সেচ পাম্প পর্যন্ত বর্তমানে বিদ্যুৎচালিত ।
এসব ক্ষেত্রে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ দরকার তার একটি হিসাব আছে । কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সে হিসাব অচল । অচলতার জন্য দায়ী প্রসাধু পন্থা । বিদ্যুৎ সরবরাহকারী কর্মচারী থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অসাধু পন্থা অবলম্বন করে থাকে বলে বিদ্যুৎ সংকট তীব্র আকার ধারণ করে ।
বিদ্যুৎ সংকটের কারণে ক্ষতির পরিমানঃ বিদ্যুৎ সংকটের কারণে দেশ প্রতিনিয়ত প্রচুর আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে এবং জাতীয় অন্যটি ব্যাবহত হচ্ছে ।বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে ক্ষেত্রটি , সেটি হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্প ।
অথচ বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে প্রতিদিন উৎপাদন ব্যাবহত হচ্ছে ,বাণিজ্যিক কমিটমেন্ট নষ্ট হচ্ছে , বিনিয়োগ ব্যাহত হচ্ছে ,সর্বোপরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি ।
অনুরূপভাবে দেশে শিক্ষা দীক্ষা , ব্যবসায় বাণিজ্য এবং কৃষি উৎপাদন ব্যবহৃত হচ্ছে । এতে দেশ ও জাতির উন্নতি চরমভাবে পিছিয়ে যাচ্ছে ।
পত্রিকা/ সংকট নিরসন /সমাধানের উপায়ঃ যেকোনো কাজেরই সমস্যা যত দ্রুত সৃষ্টি হয় , সমাধান তত দ্রুত দেওয়া অতটা সহজ নয় । আমাদের দেশের বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে যে সমস্যা বা সংকট সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সুপরিকল্পিত ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ।
যতটুকু প্রয়োজন তা যথাযথ হিসেব করে সে অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করে নিশ্চিত করা । আসার কথা যে , আমাদের রয়েছে প্রচুর প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদ । আমরা চেষ্টা করলে এ দেশকে কাজে লাগিয়ে সস্তায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সংকট নিরসন করতে পারি ।
কিন্তু যে জন্য চাই মূলধন ও প্রযুক্তি জ্ঞান বা দক্ষতা । পাশাপাশি আমরা যারা বিদ্যুৎ ব্যবহার করি , তাদেরকেও হতে হবে সচেতন । সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে ও এর সংকট কিছুটা মোকাবেলা করা সম্ভব ।
তাছাড়া বিদ্যুতের বিকল্প যেমন সৌরশক্তির ব্যবহার বা বায়োগ্যাস উৎপাদন এক কথায় বিকল্প ব্যবহারের মাধ্যমেও বিদ্যুতের সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব ।
বিদ্যুৎ সেক্টরে পরিকল্পনাঃ বর্তমান সরকার ২০১৭ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ সেক্টর একজনের পরিকল্পনার যে রুপরেখা দিয়েছেন তা নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ
ক) অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির বাইরেও প্রতিবেশী দেশ ভারত ভুটান এবং নেপালের সাথে দ্বিপাখিক বহুপাখিক এবং আঞ্চলিক সমঝোতার মাধ্যমে আরও বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বন্টনের উদ্যোগ গ্রহণ।
(খ )২০১৭সালের মধ্যে উৎপাদন ক্ষমতা ১৮,১৬২ মেগা ওয়ার্ডে উন্নতি করা ।
(গ)২০১৭ সালের মধ্যে১৪২৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন যার ফলে গ্যাস সম্পদের উপর চাপ কমানো সম্ভব যা এখন দেশের প্রায় শতকরা ৭৮ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনে অবদান রাখছে ।
(ঘ) রূপপুরে ২০০০ মেগাওয়ার্ড উৎপাদনক্ষম দুটি নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ।
ভবিষ্যৎ বিদ্যুৎ উন্নয়ন পরিকল্পনাঃসরকার বিদ্যুৎ খাতের সার্বিক উন্নয়নের সংস্কারের পাশাপাশি পাওয়ার সিস্টেমের মহাপরিকল্পিনা প্রণয়ন করেছে । পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী ২০২১ সালের মধ্যে স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৪,০০০ মেগাওয়ার্ট উন্নীত হবে ।
যথাক্রমে ১২,০০০ সার্কিট কিমি ও ৪৭৮,০০সার্কিট কি মি আগামী ২০২১ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ খাতে উন্নয়নের বর্তমান সরকারের পরিকল্পনার একটি সার সংক্ষেপ নিম্নে তুলে ধরা হলো ।
উপসংহারঃ একুশ শতকের জাতীয় অর্থনৈতিক সামাজিক বৈশ্বিক এক কথায় সার্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে উন্নতির শীর্ষে উঠতে চাইলে অন্ততপক্ষে বিদ্যুৎখাতকে চাঙ্গা করার বা উন্নত করার কোনো বিকল্প নেই ।
তাই এ সমস্যার সমাধানে আমাদের প্রত্যেককে এগিয়ে আসতে হবে এবং সচেতন হতে হবে । নতুন ও বিকল্প উপায় উদ্ভাবন করতে হবে । আর এ সংকট নিরসন হলে তবেই আসবে আমাদের অর্থনৈতিক তথা সার্বিক মুক্তি ।