কোষ হল জীবের গঠনগত ও কার্যগত একক। সমস্ত জীব কোষ দিয়ে গঠিত। কোষের প্রকৃতি হল:
- স্ব-সংরক্ষণ: কোষ নিজেকে সংরক্ষণ করতে পারে। এটি খাদ্য গ্রহণ করে, শ্বাস-প্রশ্বাস করে, এবং বর্জ্য পদার্থ অপসারণ করে।
- বংশগতির বাহক: কোষ বংশগতি বাহক। এটি DNA ধারণ করে, যা প্রজাতির বৈশিষ্ট্য বহন করে।
- বৃদ্ধি ও বিকাশ: কোষ বৃদ্ধি ও বিকাশের মাধ্যমে জীবের বৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটায়।
- প্রতিক্রিয়াশীলতা: কোষ পরিবেশের পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে।
কোষের সংখ্যা জীবের প্রকারভেদে ভিন্ন হয়। ব্যাকটেরিয়ায় একটি কোষ থাকে, আর ছত্রাকের ক্ষেত্রে একক কোষ থেকে বহুকোষী হতে পারে। উদ্ভিদের ক্ষেত্রে একক কোষ থেকে বহুকোষী হতে পারে। প্রাণীর ক্ষেত্রে একক কোষ থেকে বহুকোষী হতে পারে।
মানুষের দেহে কোষের সংখ্যা প্রায় 37 ট্রিলিয়ন। মানুষের দেহে বিভিন্ন ধরনের কোষ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, রক্তের কোষ, পেশীর কোষ, স্নায়ুর কোষ, ইত্যাদি।
কোষের সংখ্যা জীবের জীবনযাত্রার উপরও নির্ভর করে। উদাহরণস্বরূপ, স্থলজ জীবের তুলনায় জলজ জীবের কোষের সংখ্যা বেশি।
কোষের সংখ্যা জীবের বয়সের উপরও নির্ভর করে। সাধারণত, জীবের বয়স বাড়ার সাথে সাথে কোষের সংখ্যা কমে যায়।
কোষ তত্ত্ব
কোষ তত্ত্ব হল জীববিজ্ঞানের একটি মৌলিক তত্ত্ব, যা অনুসারে সমস্ত জীব কোষ দ্বারা গঠিত। এই তত্ত্বের তিনটি প্রধান নীতি হল:
- কোষ হল জীবের গঠনগত ও কার্যগত একক। অর্থাৎ, সমস্ত জীব কোষ দিয়ে গঠিত এবং কোষ হল জীবের জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত কার্য সম্পাদন করে।
- জীবের সমস্ত কোষ বিদ্যমান কোষ থেকে উৎপন্ন হয়। অর্থাৎ, নতুন কোষ শুধুমাত্র বিদ্যমান কোষের বিভাজনের মাধ্যমে উৎপন্ন হয়।
- কোষের মধ্যে সমস্ত জীবের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। অর্থাৎ, কোষের মধ্যে জীবের বংশগতিগত তথ্য এবং জীবের জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত উপাদান রয়েছে।
কোষ তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষণা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, কোষ তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে কোষের গঠন ও কার্যাবলী, কোষের বিভাজন, কোষের বিবর্তন, ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা করা হয়।
কোষ তত্ত্বের বিকাশের ইতিহাস:
কোষ তত্ত্বের বিকাশের ইতিহাসে অনেক বিজ্ঞানীর অবদান রয়েছে। তবে, এই তত্ত্বের মূল ভিত্তি স্থাপন করেন তিনজন বিজ্ঞানী:
- রবার্ট হুক (Robert Hooke): ১৬৬৫ সালে তিনি প্রথম মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে কাঠের ছিপির মধ্যে ছোট ছোট ঘর দেখতে পান। তিনি এই ঘরগুলিকে “সেল” (Cell) নাম দেন।
- থিওডোর শোয়ান (Theodor Schwann): ১৮৩৯ সালে তিনি উদ্ভিদ ও প্রাণী কোষের মধ্যে মিল খুঁজে পান। তিনি এই মিলের উপর ভিত্তি করে কোষ তত্ত্বের প্রথম নীতিটি প্রস্তাব করেন।
- ম্যাথিয়াস স্লেইডেন (Matthias Schleiden): ১৮৩৯ সালে তিনিও শোয়ানের সাথে একই সিদ্ধান্তে পৌঁছান। তিনিও কোষ তত্ত্বের প্রথম নীতিটি প্রস্তাব করেন।
পরবর্তীতে, বিজ্ঞানীরা কোষের বিভাজন ও বংশগতির উপর গবেষণা করে কোষ তত্ত্বের দ্বিতীয় ও তৃতীয় নীতিটি প্রস্তাব করেন।
কোষ তত্ত্বের গুরুত্ব:
কোষ তত্ত্ব জীববিজ্ঞানের একটি মৌলিক তত্ত্ব। এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষণা করা হয়। কোষ তত্ত্বের গুরুত্ব নিম্নরূপ:
- কোষ তত্ত্ব জীবের গঠন ও কার্যাবলী সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়াকে প্রসারিত করেছে।
- কোষ তত্ত্ব জীবের বিবর্তন সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়াকে প্রসারিত করেছে।
- কোষ তত্ত্ব জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষণার জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করেছে।
কোষ বিভাজনের প্রকারভেদ
কোষ বিভাজন হল একটি জটিল প্রক্রিয়া যা কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বংশগতির বাহন হিসেবে কাজ করে। কোষ বিভাজনের দুটি প্রধান প্রকারভেদ হল:
অ্যামাইটোসিস (Amitosis): অ্যামাইটোসিস হল একটি সাধারণ কোষ বিভাজন প্রক্রিয়া যা এককোষী জীব এবং উদ্ভিদ কোষে দেখা যায়। অ্যামাইটোসিসে, কোষের নিউক্লিয়াস ও সাইটোপ্লাজম সরাসরি বিভাজনের মাধ্যমে দুটি সমান অংশে বিভক্ত হয়।
মাইটোসিস (Mitosis): মাইটোসিস হল একটি জটিল কোষ বিভাজন প্রক্রিয়া যা বহুকোষী জীবের সমস্ত কোষে দেখা যায়। মাইটোসিসে, কোষের নিউক্লিয়াস ও সাইটোপ্লাজম একটি নির্দিষ্ট ক্রম অনুসারে বিভাজনের মাধ্যমে দুটি সমান অংশে বিভক্ত হয়। মাইটোসিসের চারটি প্রধান দশা হল:
- প্রমেয়োসিস (Prophase): এই দশায়, নিউক্লিয়াস ও ক্রোমোজোম সংকুচিত হতে শুরু করে।
- মেটাফেজ (Metaphase): এই দশায়, ক্রোমোজোম কোষের মাঝখানে একটি বিভাজন প্লেটে অবস্থান করে।
- অ্যানাফেজ (Anaphase): এই দশায়, ক্রোমোজোমের দুটি ভাঙ্গনে সৃষ্ট স্ট্র্যান্ড কোষের দুটি মেরুতে চলে যায়।
- টেলোফেজ (Telophase): এই দশায়, নিউক্লিয়াস ও সাইটোপ্লাজম দুটি সমান অংশে বিভক্ত হয়।
মাইটোসিসের মাধ্যমে যে নতুন কোষগুলি গঠিত হয় সেগুলি মূল কোষের সাথে জিনগতভাবে অভিন্ন। এই কারণে, মাইটোসিস বংশগতির বাহন হিসেবে কাজ করে।
- মিয়োসিস (Meiosis): মিয়োসিস হল একটি জটিল কোষ বিভাজন প্রক্রিয়া যা বহুকোষী জীবের প্রজনন কোষে দেখা যায়। মিয়োসিসে, মাইটোসিসের মতোই কোষের নিউক্লিয়াস ও সাইটোপ্লাজম বিভাজনের মাধ্যমে দুটি সমান অংশে বিভক্ত হয়। তবে, মিয়োসিসে প্রতিটি বিভাজনের মাধ্যমে ক্রোমোজমের সংখ্যা অর্ধেক হয়ে যায়।
মিয়োসিসের দুটি প্রধান দশা হল:
* **ম্যায়োসিস I (Meiosis I)**: এই দশায়, ক্রোমোজোমের দুটি ভাঙ্গনে সৃষ্ট স্ট্র্যান্ড কোষের দুটি মেরুতে চলে যায়। এই দশার মাধ্যমে ক্রোমোজমের সংখ্যা অর্ধেক হয়ে যায়।
* **ম্যায়োসিস II (Meiosis II)**: এই দশায়, মাইটোসিসের মতোই কোষের নিউক্লিয়াস ও সাইটোপ্লাজম বিভাজনের মাধ্যমে দুটি সমান অংশে বিভক্ত হয়। এই দশার মাধ্যমে কোষের সংখ্যা চারটি হয়ে যায়।
মিয়োসিসের মাধ্যমে গঠিত প্রজনন কোষগুলিকে গ্যামেট বলা হয়। গ্যামেটের মিলনের মাধ্যমে নতুন জীবের জন্ম হয়।
কোষ বিভাজনের গুরুত্ব:
কোষ বিভাজনের গুরুত্ব নিম্নরূপ:
- কোষ বিভাজন জীবের বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয়।
- কোষ বিভাজন বংশগতির বাহন হিসেবে কাজ করে।
- কোষ বিভাজন জীবের ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলির মেরামত ও প্রতিস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয়।
- কোষ বিভাজন ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী।
কোষ বিভাজনের প্রকারভেদ
আদি কোষ ও প্রকৃত কোষ
আদি কোষ (Prokaryote) হল এক ধরনের কোষ যাতে নিউক্লিয়স থাকে না। আদি কোষের মধ্যে রয়েছে ব্যাকটেরিয়া এবং আর্কিয়া। আদি কোষের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল:
- এগুলিতে নিউক্লিয়স থাকে না।
- এগুলিতে ঝিল্লি-ঘেরা অঙ্গাণু থাকে না।
- এগুলির জিনগত উপাদান ক্রোমোজোম আকারে থাকে।
- এগুলির কোষ প্রাচীর থাকে।
প্রকৃত কোষ (Eukaryote) হল এক ধরনের কোষ যাতে নিউক্লিয়স থাকে। প্রকৃত কোষের মধ্যে রয়েছে উদ্ভিদ, প্রাণী এবং ছত্রাক। প্রকৃত কোষের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল:
- এগুলিতে নিউক্লিয়স থাকে।
- এগুলিতে ঝিল্লি-ঘেরা অঙ্গাণু থাকে।
- এগুলির জিনগত উপাদান ক্রোমোজোম আকারে থাকে।
- এগুলির কোষ প্রাচীর থাকতে পারে বা নাও থাকতে পারে।
আদি কোষ ও প্রকৃত কোষের মধ্যে পার্থক্য
বৈশিষ্ট্য | আদি কোষ | প্রকৃত কোষ |
---|---|---|
নিউক্লিয়স | নেই | আছে |
অঙ্গাণু | নেই বা কম | আছে |
জিনগত উপাদান | ক্রোমোজোম আকারে | ক্রোমোজোম আকারে |
কোষ প্রাচীর | আছে | আছে বা নেই |
আদি কোষের উদাহরণ
- ব্যাকটেরিয়া
- আর্কিয়া
প্রকৃত কোষের উদাহরণ
- উদ্ভিদ কোষ
- প্রাণী কোষ
- ছত্রাক কোষ
কোষের গঠন ও কার্যকারিতা
কোষ হল জীবের গঠনগত ও কার্যগত একক। সমস্ত জীব কোষ দিয়ে গঠিত। কোষের গঠন ও কার্যকারিতা নিম্নরূপ:
কোষের গঠন
কোষের প্রধান গঠনগত উপাদানগুলি হল:
- কোষঝিল্লি: কোষঝিল্লি হল কোষের বাইরের আবরণ। এটি একটি পাতলা, তরল পদার্থ দ্বারা গঠিত। কোষঝিল্লি কোষকে বাইরের পরিবেশ থেকে পৃথক করে এবং কোষের ভিতরে থাকা উপাদানগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে।
- সাইটোপ্লাজম: সাইটোপ্লাজম হল কোষের ভেতরের অংশ। এটি একটি জেলির মতো পদার্থ দ্বারা গঠিত। সাইটোপ্লাজমে বিভিন্ন অঙ্গাণু থাকে।
- নিউক্লিয়াস: নিউক্লিয়াস হল কোষের কেন্দ্রে অবস্থিত একটি গোলাকার অঙ্গাণু। এটি কোষের জিনগত উপাদান ধারণ করে।
উদ্ভিদ কোষের গঠন
উদ্ভিদ কোষের গঠন প্রাণী কোষের গঠনের সাথে অনেকটা মিল। তবে, উদ্ভিদ কোষে কিছু অতিরিক্ত গঠন রয়েছে, যেমন:
- কোষ প্রাচীর: কোষ প্রাচীর হল কোষের বাইরের একটি শক্ত আবরণ। এটি কোষকে শক্তি ও স্থিতিস্থাপকতা প্রদান করে।
- ক্লোরোপ্লাস্ট: ক্লোরোপ্লাস্ট হল একটি সবুজ রঙের অঙ্গাণু। এটি সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার জন্য দায়ী।
- ভ্যাকুওল: ভ্যাকুওল হল একটি বড়, তরলপূর্ণ অঙ্গাণু। এটি কোষের বৃহত্তম অঙ্গাণু। ভ্যাকুওল কোষের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং পুষ্টি জমা করে।
প্রাণী কোষের গঠন
প্রাণী কোষের গঠন উদ্ভিদ কোষের গঠনের সাথে অনেকটা মিল। তবে, প্রাণী কোষে কিছু অতিরিক্ত গঠন রয়েছে, যেমন:
- সেন্ট্রোসোম: সেন্ট্রোসোম হল একটি ছোট, গোলাকার অঙ্গাণু। এটি কোষ বিভাজনের জন্য দায়ী।
- লিউকোপ্লাস্ট: লিউকোপ্লাস্ট হল একটি বর্ণহীন অঙ্গাণু। এটি বিভিন্ন ধরনের কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়, যেমন খাদ্য সঞ্চয়, বিপাক প্রক্রিয়া, এবং কোষের প্রতিরক্ষা।
কোষের কার্যকারিতা
কোষের প্রধান কার্যকারিতাগুলি হল:
- বৃদ্ধি ও বিকাশ: কোষ বিভাজনের মাধ্যমে কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কোষের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে জীবের বৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটে।
- বংশগতি: কোষের নিউক্লিয়াসে অবস্থিত ডিএনএ (DNA) জীবের বংশগতিগত তথ্য বহন করে। কোষ বিভাজনের মাধ্যমে ডিএনএ নতুন কোষে স্থানান্তরিত হয়। এইভাবে, বংশগতি বজায় থাকে।
- উপাদান বিপাক: কোষ বিভিন্ন উপাদান বিপাক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি উৎপাদন, পুষ্টির শোষণ, এবং বর্জ্য পদার্থ অপসারণ করে।
- সংবেদন ও প্রতিক্রিয়া: কোষ পরিবেশের পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। এই প্রতিক্রিয়াটি কোষের বাইরের অংশে অবস্থিত সংবেদনশীল অঙ্গাণু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
কোষের গুরুত্ব
কোষের গুরুত্ব নিম্নরূপ:
- কোষ হল জীবের গঠনগত ও কার্যগত একক।
- কোষ বিভাজনের মাধ্যমে জীবের বৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটে।
- বংশগতি কোষের মাধ্যমে বজায় থাকে।
- **কোষ বিভিন্ন উপাদান বিপাক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি উৎপাদন, পুষ্টির শোষণ, এবং বর্জ্য পদার্থ অপসারণ করে।