পন্ডিত সাহেব – কাজী আবদুল ওদুদ

বন্ধু বললেন এত কাছে এবার সাহিত্য সম্মেলন হচ্ছে চলো দেখে আসা যাক। আমি বললাম কি সেখানে হবে তার কল্পনা করা তোমাদের পক্ষে এতই কি শক্ত?

তারা বললেন রাখো তোমার প্রেমে এবার যেতেই হবে তৈরি হও। নির্দিষ্ট দিনে মুন্সিগঞ্জ অভিমুখে রওনা হওয়া গেল।

যাচ্ছিলাম আমরা বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে বটে, কিন্তু সেদিন আমাদের সত্যিকারের ব্যাপার ছিল নিরুদ্দেশ ভ্রমণ।

গন্তব্য স্থানে পৌঁছা  গেল। আমাদের বাস নির্দিষ্ট হলো শহরের কিছু বাইরে মাঠের মাঝখানে এক  দালানে।

চারদিকে খোলা মাঠ; কিছু দূরে প্রবাহিত হচ্ছে পদ্মা- অভিসারী এক খাল; কৃষক-পল্লী, শুধু সবুজ গাছের ভিড় ; চষা পরিপাটি মাঠে শোভা পাচ্ছে চারা  ধান গাছ।

মনে মনে খুশি হয়ে ভাবলাম, আমাদের এবারকার নিরুদ্দেশ ভ্রমণের ওপর বিধাতার সুন্দর হস্তের আশীর্বাদ বর্ষিত হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি।

যথাসময়ে সম্মেলনে উপস্থিত হওয়া গেল। যথাবিহিত অভিনয় আপ্যায়ন আপ্পায়ন শুনিস পণ্য হল। সাহিত্যমহারথেবিন্দু একে একে তাদের অভিভাষণ পাঠ করে চললেন।

যখন করতালির প্রয়োজন গল্প আর ধূমপান ক্ষণকালের জন্য বন্ধ করে তা সমাধা করে শ্রোতা মন্ডলী নিজে দের সমজ দাড়ির পরিচয় দিলেন।

বাংলা সাহিত্যের উৎপত্তি, তার বর্তমান অবস্থা, তার ভবিষ্যত, তার চমৎকারিত্, তার ত্রুটি।

বাঙালির জাতীয় জীবনের দুর্বলতা, তার ভবিষ্যত, কর্তব্য ইত্যাদি বিষয়ে বহু মন্তব্য শ্রবণ করবার সৌভাগ্য আমাদের হলো।

তা রাতে ফিরে এসে গ্রাম্য বাবুর্চির বিশুদ্ধ পোলাও, টার্কি মুরগির কোরমা আর রামপালে কলা উদরস্থ করে  ভলেন্টিয়ার দের ভূয়সী প্রশংসা করলাম, আর মনে মনে ভাবলাম- যাক, আমাদের এবারকার নিরুদ্ধেশ ভ্রমণ কিছুতেই গেজে যাবে না  এমন পারে আশা করতে পারি।

জ্যোৎস্না আলোকিত মাঠের মাঝখানে এই ঘরটিতে বহু রাত পর্যন্ত দরজা-জানালা খুলে রেখে শেষে ঘুমিয়ে পড়া গেল।

গানের শব্দ সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখি, পাশের বিছানায় বসে এক বন্ধু ভৈরবী-ললিত মেশানো একটি গান গাচ্ছেন।

আমার পানে চেয়ে তিনি হাসলেন, আমিও হাসলাম। পাশে চাইতে দেখলাম- একজন গ্রাম্য ‘মুসল্লী’- গাছের লোক চেয়ারে বসে আমারি দিকে চেয়ে আছেন।

তিক।আদাব  করলেন; আমি আদাব  করলাম কালো স্বাস্থ্য-সম্মত জোয়ান চেহারা তার,  মুখে অনম্ম ঝাক্রা দাড়ি, কালো পুরুষদের ওপর খাটো করে চোখ দুটো ছোট তাতে যে দৃষ্টিতে যথেষ্ট অউজ্জল্ল ।

তহবন পরা লম্বা নীল করতা গাএ  বলিষ্ঠ ব্যক্তি বিনীতভাবে আমার বিছানায় এক পাশে এসে বসলেন। তার বাঁ হাতে কএক্ষানি খাতা একখানি খুলে আমার সামনে রেখে বললেন, এক আমি বইখানা  লিখেছি।

মেহেরবানী করে একটু পড়ে দেখুন। কিছু শুনতে খালি হাতে উল্টিয়ে এখানে অখানে দেখতে লাগলাম দু এক জায়গায় লেখার যে বাঁধনি চোখে পড়ল তাতে কিছু বিষয় বদ হল।

তাকে বললাম, আপনি  পরুন  আমি শুনি। তিনি পড়তে লাগলেন। প্রথম ছেলে মেয়েদের কি করে  বানান শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে, সেই সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন। এজে ভূমিকা তিনি পড়লেন তার কয়েকটি কথা এই।

যে পথ দুর্গম চেষ্টা করে সে পথকে সুগম করা যায়। যা জটিল তাও চেষ্টা করে আয়ত্ত করা যায়, আর তা আয়ত্ত করার জগ সহজ পথ নির্দেশ করা যায়;

তবে কেন সরলমতি শিশুদের মনে ভীতি অথবা অরুচি উৎপাদন না করে তাদের মাতৃভাষা বর্ণবিন্যাস স্বাভাবিকভাবে শিক্ষা দেওয়া যাবেন আমার আন্তরিক প্রশংসার ক্ষতি ছিল না। মাঝে মাঝে অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে লক্ষ করেছিলাম- সত্যান্বেষীর পক্ষে।

অবশ্যলব্য জীববিজ্ঞান দৃষ্টি এই অল্প শিক্ষিত গ্রাম্য লোকটির পক্ষে তা কি অদ্ভুত ভাবে সম্ভব্পর  হয়েছে। পড়া শেষ হলে তাকে সাধুবাদ প্রদানের কার্পণ্য করতে পারলাম না।

তিনি বললেন, এটি প্রকাশ করতে তিনি  বললেন এটি প্রকাশ করতে ইচ্ছুক , কিন্তুতার মত নগন্য ব্যাক্তির আদর কি স্কুল কর্তৃপক্ষের করবেন।আমি বললাম, এ ব্যাপারে  আবারো ক্ষমতা তারই মত,  তবে অন্য কোন উপায়ে যদি আমার দ্বারা কোনো কাজ হয় তাতো নিশ্চয়ই করব।

লোকটির সঙ্গে আলাপের গাঢ়ত্ব সহজেই সম্ভবপর হলো। অতি  অল্পক্ষণ কথাবার্তার পরে তার দৈনন্দিন জীবনের নানা ছোট ছোট কথা জিজ্ঞাসা করতে পারলাম ।

সহজ ভাবে তিনি সে সমস্তের উত্তর দিলেন। গানের পাঠশালা শিক্ষক; বহুকাল পর্যন্ত  গ্রামের ‘খাতিব’ ও শিলেন ; কোনরকমে দিন গুজরান হয় অর্থাৎ- বাংলা বাংলার মুসলমান হাজার করা 999 জনের যে রকম হয়। আমাদের আলাপ এগিয়ে চলল।

শেষে এমন একটা জীবনের ছাপ আমার চিত্রপটে মুদ্রিত হলো যা গ্রাম্য পণ্ডিতের নয়, কবিসসঃ প্রার্থীদেরও নয়,-যার প্রত্যাশা এবারকার নিরুদ্দেশ যাত্রা স্বপ্নেও মনে স্থান দিতে পারিনি।

একে একে তার 15 বছরের শিক্ষকতার কথা  আমাকে বললেন। গ্রামের লোকেরা তার প্রতি সদয় নয়। স্কুলের ছাত্ররা প্রায় বৃত্তি পায়; স্কুল- পরিদর্শক তার প্রশংসা করেনঃ এসমস্ত আর গ্রামের লোকদের চোখে সহ্য হয় না।

আমি বললাম, সে চেষ্টা কি আর তারা করেনি কিন্তু স্কুল খুলে কদিন চালাবার ক্ষমতা তাদের আছে। দুইবার খুব তোড়জোড় 2 স্কুল খুলেছিল।তাদের  স্কুল আর কদিন চলতে পারে।

ছাত্রদের পড়ানো হয় না, তারা পাশ করতে পারে  না, তারা পালিয়ে শেষে আবার আমার স্কুলে এসে ভর্তি হল। হেসে বললেন, পেটে বিদ্যে বুদ্ধি কিছু থাকলে তো ইস্কুল চালাতে পারবে দিলখোলা হাসি , তবে এর পর্যায় বিদ্রূপের বিষ  আর ব্যর্থতার প্রতিঘাত।

 গ্রামবাসীদের সঙ্গে তার মনমালিন্য প্রকৃত কারণ কিছু অনুমান করতে পারলাম। তবুও বললাম এত আড়াআড়ি কথা। কি নিয়ে এদের সঙ্গে আপনার মনমালিন্য সূত্রপাত যাতে তারা ভিন্ন স্কুল খুলেছিল?

তিনি বললেন, তারা গ্রামের মাতব্বর। তাদের চাই সাত দিইনে। আমাকে প্রকারান্তরে মিথ্যা স্বাক্ষী দিতে বলে; তা আমি দেব  কেন।

এইসব নিয়েই আমার সঙ্গে বিরোধ। সে বহু কথা। একবার এক মাতব্বরের ছেলে ইদ্দত পার না ।

হতেই এক বিধবাকে নিয়ে পড়তে লাগলো হয়ে উঠল।  আমাকে নিয়ে পড়িয়ে দিতে বললে। আমি বললাম সবার বিরুদ্ধে কাজ আমি পারবো না। এনিয়ে মোড়ল আমার উপর মা খাপ্পা।

এইসব মেরুদন্ড সম্পূর্ণ আত্মাভিমানী গ্রাম্য পণ্ডিতের প্রতি এক আন্তরিক স্নেহ আর  মহানভুতিতে আমার হৃদয় ভরে উঠছিল।  একধার থেকে তিনি গ্রামবাসীদের শ্রদ্ধে করে চলে ছিলেন। এরা লোভ দেখিয়ে নামাজ পড়ে।

পরের অনিষ্ট আর নিজের স্বার্থ সিদ্ধির দিকেই এদের মন এরা নাম নামেমাত্র মুসলমান কাজে একদম পশু।

ইত্যাকার  বচনে তাদের বিস্তৃত পরিচয় দিয়েছিলেন। হাসিমুখে তার সমস্ত কথা শুনছিলাম, আর ভাবছিলাম মুকুলিত আম গাছ তার অগ্র গন্ধে কেন দশদিক আন্দোলিত করে তোলে, আর তার পাশে শেওড়া গাছ কেন  শ্রীহীন চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এ তত্ত্বের তাৎপর্য গ্রহণ তোমার জন্য নয়।

শেষে পন্ডিত বললেন এরা যে কি সব জাহেল তা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। কতগুলো মেয়ে আমার কাছে কোরআন শরীফ  পড়ে।  তারই ভিতরে একটি মেয়েকে কেন আসলো আর পড়াশোনায় দক্ষ হয়েছিল।

কোরআন শরীফ খতম করেছিল। উর্দু   মেস্ফতাহজান্নাহ  শেষ করেছিল। বাংলা নিম্ন প্রাইমারি পর্যন্ত পড়েছিল, কিন্তু সাহিত্যের উচ্চ প্রাইমারি ক্লাস এর ছাত্র ছাত্রীরা হোক তার কাছে কিছু নয়।

আর কি তার হাতের লেখা! স্কুলসাব- ইন্সপেক্টর বলেছিলেন এ পর্যন্ত নিম্ন প্রাইমারি কোন ছাত্র-ছাত্রী লেখায় তিনি অত সুন্দর দেখেননি। জাহেলরা আমাকে জব্দ করার জন্য তাদের বিয়ে দিলে এক আকাট মূর্খের সঙ্গে।

তার কন্ঠ ভারী  হয়ে এল, মুখ ফিরিয়ে জামার আস্তিনে তিনি চোখ মুছলেন।আমি স্তব্ধ হয়ে  ক্ষণকাল তার মুখে পানে চেয়ে রইলাম। শেষে ধীরে ধীরে বসলাম তা মেয়েটির বাপ মা তিনি বললেন,  বেশি টাকা তারা পেলে আর তারা কি দেখবে।

অদূরে বর্ষা আমার এক  ইতিহাসঘ মমিনুল আমাদের কথাবার্তা শুনছিলেন। তিনি বললেন যারা অগ্রবর্তী চিরকালই তাদের কষ্ট ভোগ করতে হয়।

পেস্টালোজ্জি যখন তার নব উজ্জ্বল পদ্ধতি অনুসারে শিশু শিক্ষা বিধানে অগ্রসর হলেন, অভিভাবকরা তার কাছে সন্তান পাঠাতে পর্যন্ত রাজি হলেন না। রাস্তা  বেওয়ারিশ ছেলেদের নিয়ে প্রথমে তার নতুন ধরনের শিক্ষা চলল। কিন্তু হায় এর কি কোন সান্ত্বনা আছে!

নীরবে বসে তার বেদনা মাথা চিত্রের আর জ্বালা অনুভব করতে চেষ্টা করছিলাম। ইচ্ছা হচ্ছিল বলি আপনার যে দুঃখ তা বহনের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত বলেইতো বাংলার মুসলমান আজ হতভাগ্য।

তা আর সাহস হলো না। কথাটা তার কাছে হেঁয়ালি মত শোনাবার সম্ভাবনাই বেশি। সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তাকে জয়ী হতে হবে, শেষ এইসব বিদায় দিলাম। সম্মেলন বৈঠক 23 জায়গা তিন দিন হলো।

সুদক্ষ সূরা লাহাব গান উদ্ভাসিত মাঠে বাসের রোমাঞ্চ তেমনি চলল। কিন্তু সেদিনের সমস্ত মুখ স্মৃতির পুষ্প দলের মাঝখানে কাঁচা নবীন ফলের মতো জেগে রয়েছে এই গ্রাম্য শিক্ষকের স্মৃতি।

সেখানে আলাপের দিনের অবসানে রাত্রে সেই মাঠে ভিতরকার দালানে পায়চারি করতে করতে দূরে গ্রামে পানে চেয়ে ভাবছিলাম তার কথা। দুর গতানুগতিক সর্ব প্রকারের দরিদ্র গ্রামবাসীদের মাঝখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।

কিছু  উগ্র আত্ম আত্মভিমানী  ন্যায়-নিষ্ঠা উন্নত জীবনের  আগনিয় আকর্ষণে আকৃষ্ট এই অর্ধশিক্ষিত পুরুষ। সে   সেবারকারসাহিত্য সম্মেলনে এই ছিল আমার সবচাইতে বড় সত্যের আবিষ্কার।

আজ পুনরায় যখন সেই স্মৃতি মনে ভেসে উঠছে তখন দেখছি, সত্য এ এক আবিষ্কার।সর্ব প্রকারের অর্ধঃপতিত বাংলার বিশাল মুসলমান সমাজের পুঞ্জিভূত প্রাণহীনতার মাঝে কোথায় হেথায় ক্বচিৎ কখনো সত্যকার প্রাণস্পন্দন ও যে অনুভব করা যায়, তারি আবিষ্কার।

কিন্তু সেদিন ভেবে কিছু দুঃখিতই হয়েছিলাম, এই সামান্য প্রাণশক্তি চারপাশে ঘিরে কি মৃত্যু তার গ্রাস এ কতক্ষণ এড়িয়ে থাকতে পারে!

আজ যখন ভাবছি দূরে গন্ডগ্রামে সেই পন্ডিত নিত্য আর পারিপার্শ্বিক ভিন্নতার সঙ্গে যুঝছেহয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, তার জন্য সহানুভূতি হলেও দুঃখবোধ নেই।

এই শতকার প্রাণবহ্নি নির্বাপিত হওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁর পরিবেষ্টনকে  দহন করে চলবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *