বাংলাদেশের কুটির শিল্পের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ এবং প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে কুটির শিল্পের সম্ভাবনা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।সরকারের উদ্যোগবাংলাদেশ সরকার কুটির শিল্পের উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) প্রতিষ্ঠা: বিসিক কুটির শিল্পের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের সহায়তা প্রদান করে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে প্রশিক্ষণ, ঋণ, বিপণন সহায়তা ইত্যাদি।
- কুটির শিল্পের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা: সরকার কুটির শিল্পের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেছে। এর মাধ্যমে কুটির শিল্পের জন্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাবে।
- কুটির শিল্পের পণ্যের জন্য রপ্তানি প্রণোদনা প্রদান: সরকার কুটির শিল্পের পণ্যের জন্য রপ্তানি প্রণোদনা প্রদান করে থাকে। এর মাধ্যমে কুটির শিল্পের পণ্য বিদেশে রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে।
প্রযুক্তির উন্নয়নপ্রযুক্তির উন্নয়ন কুটির শিল্পের জন্য একটি সুযোগ। প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে কুটির শিল্পের উৎপাদনশীলতা ও গুণমান বৃদ্ধি করা সম্ভব।কুটির শিল্পের সম্ভাবনাবাংলাদেশে কুটির শিল্পের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতিফলন: কুটির শিল্পে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটে। এটি বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
- কর্মসংস্থানের সুযোগ: কুটির শিল্পে বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। এটি দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করে।
- রপ্তানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা: কুটির শিল্পের পণ্যের চাহিদা বিশ্বব্যাপী রয়েছে। প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে কুটির শিল্পের পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধি করা সম্ভব।
সরকারের উদ্যোগ এবং প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশের কুটির শিল্পের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। কুটির শিল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সম্ভব।
কুটির শিল্পের ভবিষ্যৎকে আরও উজ্জ্বল করার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:
- কুটির শিল্পের জন্য আরও বেশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
- কুটির শিল্পের জন্য সহজলভ্য ঋণের ব্যবস্থা করা।
- কুটির শিল্পের পণ্যের জন্য বিপণন সহায়তা বৃদ্ধি করা।
- কুটির শিল্পের পণ্যের জন্য রপ্তানি প্রণোদনা আরও বাড়ানো।
এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণের মাধ্যমে কুটির শিল্পকে আরও বেশি লাভজনক এবং প্রতিযোগিতামূলক করে তোলা সম্ভব হবে।
কুটিরশিল্পের অতীতঃ অতীতে বাংলাদেশের কুটির শিল্পের গৌরবময় ঐতিহ্য ছিল । ঢাকা মসালিন এক সময় সারাবিশ্ব থেকে বাংলার সুখ্যাতি বয়ে এনেছিল । বাঁশ বেত ধাতব , বিড়ি মুৎশিল্প প্রভৃতি কুটির শিল্পের কারুকার্যময় জিনিস একসময় বাংলার ঘরে ঘরে প্রবা পেত ।
প্রত্যাহিক প্রয়োজনে মানুষ স্ব=স্ব মর্যাদা ও বংশের ধারায় কুটির শিল্পের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত । কিন্তু আঠারো শতকে ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের পর আমাদের কুটির শিল্প ক্রমে ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হয়েছে ।
কুটির শিল্পের বর্তমানঃ ইংরেজ আধিপত্যে কুটির শিল্পের ধ্বংস ত্বরান্বিত হয় । কিন্তু এ পর্যায়ে এসে এ শিল্প নতুন ক্ষেত্র নির্মাণ করে দিল । ঢাকাই মসলিম হারানোর দুঃখ কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেওয়া হয়েছে জামদানি শাড়ি ও রাজশাহীর রেশম শিস্কের শাড়ির মাধ্যমে ।
অনুরূপ গৃহ নির্মাণে পোড়ামাটির পৌকর্যময় কাজ হারানোর দুঃখও অনেকটা মিলিয়ে গেল শৈল্পিক মৎশিল্পের পুনরুত্থানের দ্বারা । বর্তমানে আবার কুটির শিল্পের কদর বেড়েছে বাঙালি মধ্যবিত্তের ঘরে ।
কুটির শিল্পের প্রকারভেদ
বাংলাদেশের কুটির শিল্পকে নির্মাণ সামগ্রীর বিভিন্নতা অনুসারে কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায় । যেমনঃ তাঁতশিল্প , রেশমশিল্প , মৃৎশিল্প ধাতবশিল্প বেতশিল্প শঙ্খশিল্প ও কাগজশিল্প ।
ঢাকার মসলিনঃ ঢাকার মসলিন এখন কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে । কিন্তু একটা সময় ছিল যখন গ্রিস রোম ও পারস্যের রাজকুমারী ও সম্রাজ্ঞীদের জন্য এটি ছিল পরম আকাঙ্ক্ষিত বস্তু । এটি পৃথিবীর মানুষের কাছে বিস্ময়ের গুড় লাগিয়ে দিয়েছিল ।
তাঁত জামদানিঃ মসলিন ধ্বংস হওয়ার পর সেই গৌরবরব অনেকটা ফিরিয়ে এনেছে জামদানি শাড়ি । বিদেশে এই শাড়ির কদর উত্তরোওর বেড়েই চলেছে । পাশাপাশি পাবনা বিটি ও তাঁতের শাড়ি টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি এখন অত্যন্ত জনপ্রিয় ।
কুমিল্লার খাদি কাপড় আজ ও আমাদের তাঁতশিল্পের জন্য গৌরর্বের । বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে তাঁত শিল্পের ভূমিকা অনেক । তাঁতে তৈরি শারি, লুঙ্গি , গামছা , ধুতি ও বিছানার চাদর আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অতীব প্রয়োজনীয় ।
রেশম শিল্পঃ কুটির শিল্পের মধ্যে রাজশাহীর রেশমশিল্প একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে । এ শিল্প একসময় গুণগতমান ও উৎকর্ষে বিশ্বখ্যাত ছিল । রংপুর দিনাজপুরেও এ শিল্পবিস্তার লাভ করেছে ।
কাগজ ও প্লাস্টিক শিল্পঃ বাংলাদেশের কুটির শিল্প গ্রামীণ সীমানা ছাড়িয়ে শহরেও প্রভাব বিস্তার করেছে । শহরের স্বল্প আয়ের মানুষ কাগজ ও প্লাস্টিকের নানাবিট ফুল তৈরি করছে । আর এ ফুল দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে
মৃৎশিল্পঃ পোড়ামাটির টালি, শৈল্পিক কারুকার্য মূর্তি গৃহে ব্যবহারযোগ্য ও প্রদর্শনযোগ্য ছোট্ট খাটো জিনিসপত্র যেমনঃ পেপার ওয়েট মাটির ব্যাংক পশুপাখি মাছ মেয়েদের অলংকার প্রবৃত্তি । প্রায় সব মেলায় এর বিলুপ ও সমাদর লক্ষণীয় ।
বাস বেত ও কাঠের তেজপএঃসিলেটের বেটে টেবিল চেয়ার সোফাসেট এখন আভিজাত্বর প্রতীক । প্রচুর পরিমাণে বাঁশের তৈজসপত্র সাধারণ ও সৌখিন ব্যবহারে কাজে লাগছে । কাঠের তৈরি জিনিসপত্র সর্বত্রই ব্যবহৃত হচ্ছে ।
ধাতব কাজঃ অলংকার নির্মাণের সোনা ও রুপার কদর এখনো প্রশ্নাতীত । পিতল , কাঁসা ও লোহার তৈজসপত্র বিলুপভাবে সমাদৃত । এ জবের কোনো বিকল্প নেই বললেই চলে ।
লবণ ও বিড়িঃ খাদ্যদ্রব্যের উপকরণ লবণে সবটাই কুটির শিল্পজাত । প্রধানত কক্সবাজার ও চট্টগ্রামেই লবণ উৎপাদিত হয় । আর ধূমপানের উপকরণ বিড়ি কুটির শিল্পের মধ্যে এক সময়ে সবচেয়ে বড় শিল্প ।
চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্যঃ যান্ত্রিক শিল্পের দখলে চলে গেলেও কুটির শিল্প চামড়া ও চামরা যা দ্রব্যদি প্রস্তুতে ও যথেষ্ট এগিয়ে আছে । চামড়ার পোশাক চামড়ার ব্যাগ ও জুতো সৌখিন দ্রব্যদি এ শিল্পের আওতাভুক্ত ।
গণ আসনঃ শীতলপাটি মাদুর ও নকশী কাঁথা গন আসন হিসেবে এ দেশে স্বীকৃত । আর এর সবটাই কুটির শিল্পের আওতায় তৈরি হয় । এগুলো ঐতিহ্য সচেতনতা ও রুচির পরিচয় বহন করে ।
কৃষি উপকরণঃ কৃষি কাজের জন্য নির্মিত মই লাঙ্গল থেকে শুরু করে দা কাচি কোদাল প্রভৃতি কুটির শিল্পজাত উপকরণ ।
কুটির শিল্পের বর্তমান দুরবস্থার কারণঃ কুটির শিল্পের বর্তমান দুররবস্থার প্রধান কারণ ব্রিটিশ ষড়যন্ত্র । আর দ্বিতীয় কারণ শিল্প বিপ্লব ।
কুটির শিল্পের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যর চেয়ে যন্ত্রের উৎপাদিত পণ্য সুন্দর সুগঠিত ও নিপুন এবং দামেও অনেক সস্তা । কাজেই দেশীয় শিল্প প্রতিযোগিতায় হেরে যায় । আর এর ফলে ধ্বংসের দ্বার উন্মুক্ত হয় ।
বর্তমান অবস্থা থেকে নিষ্কৃতির উপায়ঃ কুটির শিল্পের অবস্থা থেকে পরিএাণের প্রধান উপায় গণসচেতনতা । আর দ্বিতীয় প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ ও আগ্রহ । এছাড়া বেসরকারি সংস্থাগুলোর কুটির শিল্প স্থাপনে আগ্রহ সৃষ্টি করা ও এ শিল্পের বাজার নিশ্চিত করা ।
এ শিল্পের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা । বাংলাদেশের কুটির শিল্পকে উৎসাহিত ও সম্প্রসারিত করার জন্য বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে ।
এই সংস্থাটি যদি কুটির শিল্পকে উৎসাহিত করে, পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে তবে এ শিল্প তার হারানো গৌরব উদ্ধার করতে সক্ষম হবে ।
কুটির শিল্পের প্রভাবঃ আমাদের দেশে শুধু শিল্পক্ষেত্রে নয় সামাজিক জীবনেও কুটির শিল্পের অবদান অপরিসীম । কুটির শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ।
তারা বংশনুক্রমে জীবিকা অর্জনের জন্য শিল্পের নাম অনুসারে বংশ ও জাতি হিসেবে পরিচিতি হয়েছে । আমার কুমার মিস্ত্রি জুতার ইত্যাদি জাতির উদ্ভব এভাবে ।
কুটির শিল্পের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাঃ ও সংস্কৃতি সাথে মানুষের মনের টান চিরন্তন । অনুভূতির স্পর্শ পেতে হলে কুটির শিল্পের দ্বারস্থ হতে হয় । যেহেতু হৃদয়ের আবেদন সর্বকালীন সেহেতু কুটির শিল্পের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য ।
কুটির শিল্পের সম্ভাবনাঃ কুটির শিল্পের সমস্যা যেমন রয়েছে, তেমনই সম্ভাবনা ও প্রচুর । মূলত কুটিরশিল্পকে উজ্জীবিত করার মাধ্যমে দেশীয় শিল্প চাঙ্গা করা যায় ।
এ শিল্পের মাধ্যমে বেকারদের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে । আবার বৈদেশিক মুদ্রা ও অর্জিত হবে । কুটির শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা সম্ভব ।
উপসংহারঃ মূলত কুটির শিল্পের সুবিধা লালন ও বধনের জন্য সরকারের বলিষ্ঠ সহযোগিতা প্রয়োজন । যন্ত্রশিল্পের পাশাপাশি কুটির শিল্পের যথার্থ শ্রীবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধিতেই দেশের প্রকৃত শিল্পোন্নয়ন ও বেকার সমস্যার সমাধান সম্ভব ।
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ ও ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে খুঁটির শিল্পের প্রতি জনগণকে আকৃষ্ট ও সচেতন করতে পারলে এ শিল্পের প্রসার অবশ্যম্ভাবী ।