প্রেগন্যান্সির লক্ষণ বা গর্ভাবস্থার প্রথম সংকেত নারীকে সচেতন করে তোলে যে তার শরীরে কিছু পরিবর্তন হচ্ছে। এই পরিবর্তনগুলি কিছুদিন পরেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সাধারণত, গর্ভাবস্থার প্রথম মাসেই কিছু শারীরিক এবং মানসিক লক্ষণ দেখা দিতে পারে। তবে, প্রতিটি নারীর গর্ভাবস্থা আলাদা হতে পারে, তাই লক্ষণগুলি একেকজনের মধ্যে ভিন্ন হতে পারে। এখানে কিছু সাধারণ লক্ষণ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
মাসিক বন্ধ হওয়া (Missed Period)
মাসিক বন্ধ হওয়া বা “মিসড পিরিয়ড” সাধারণত তখন হয় যখন একজন নারীর মাসিক চলাচল (মেনস্ট্রুয়েশন) নিয়মিত না হয় বা এক মাসে তার মাসিক না আসে। এর পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে, যেমন গর্ভধারণ এটি মাসিক বন্ধ হওয়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণ। গর্ভাবস্থায় মাসিক বন্ধ হয়ে যায়। মানসিক চাপ অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা উদ্বেগও মাসিকের সময় পরিবর্তন করতে পারে। ওজনের পরিবর্তন খুব কম বা অত্যধিক ওজন হারানোও মাসিক বন্ধ হতে পারে। হরমোনাল সমস্যা পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম (PCOS) বা থাইরয়েডের সমস্যা হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে মাসিকের সময় পরিবর্তন ঘটাতে পারে। অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম অতিরিক্ত শরীরচর্চা বা শারীরিক পরিশ্রমও মাসিক বন্ধ করে দিতে পারে। এম্বুলেটরি বা ব্যর্থতা কিছু মেডিকেল কন্ডিশন যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা অন্য কোন স্বাস্থ্য সমস্যা মাসিকের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
বমি বমি ভাব বা মর্নিং সিকনেস (Morning Sickness)
প্রেগন্যান্সির প্রথম কয়েক সপ্তাহে বমি বমি ভাব বা মর্নিং সিকনেস একটি সাধারণ লক্ষণ। এটি হরমোনাল পরিবর্তন এবং শরীরে অন্যান্য পরিবর্তনের কারণে হয়। মর্নিং সিকনেস সাধারণত সকালে বেশি অনুভূত হয়, তবে এটি দিনে যেকোনো সময় হতে পারে। এটি গর্ভধারণের প্রথম ৩ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, তবে কিছু মহিলার ক্ষেত্রে এটি আরও দীর্ঘ সময় পর্যন্ত থাকতে পারে।
মর্নিং সিকনেসের অন্যান্য কিছু লক্ষণ হল:
- তীব্র বমি ভাব
- খাওয়ার প্রতি অরুচি
- গা জ্বালাপোড়া অনুভব
- কিছু নির্দিষ্ট গন্ধ বা খাবারের প্রতি সংবেদনশীলতা
স্তন সংবেদনশীলতা বা ব্যথা (Breast Tenderness)
প্রেগন্যান্সির প্রথম লক্ষণগুলোর মধ্যে স্তন সংবেদনশীলতা বা ব্যথা (Breast Tenderness) একটি সাধারণ উপসর্গ। প্রেগন্যান্সির শুরুতে, শরীরে হরমোনের পরিবর্তন হতে থাকে, বিশেষ করে প্রোজেস্টেরন এবং এস্ট্রোজেনের মাত্রা বাড়ে, যা স্তনগুলোর টিস্যুতে প্রভাব ফেলতে পারে। এর ফলে স্তনগুলো সাধারণত বেশি সোঁদা, ফুলে উঠা বা ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এই ব্যথা বা সংবেদনশীলতা প্রেগন্যান্সির প্রথম কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দেখা দেয় এবং পরবর্তী সময়ে কিছুটা কমে যেতে পারে। তবে, এটি প্রতিটি মহিলার ক্ষেত্রে আলাদা হতে পারে, কিছু মহিলার ক্ষেত্রে এই লক্ষণ দীর্ঘ সময় থাকতে পারে।
ক্লান্তি বা অবসাদ (Fatigue)
প্রেগন্যান্সির প্রথম দিকের লক্ষণগুলির মধ্যে ক্লান্তি বা অবসাদ (Fatigue) অনেক সাধারণ। এটি মায়ের শরীরে হরমোনাল পরিবর্তন, বিশেষ করে প্রজেস্টেরন হরমোনের পরিমাণ বাড়ার কারণে হতে পারে। প্রজেস্টেরন হরমোন শরীরকে বিশ্রামের দিকে প্রবণ করে, ফলে আপনি সহজেই ক্লান্ত বা অবসাদ অনুভব করতে পারেন। এছাড়া, শরীর অতিরিক্ত কাজ করছে, যেমন গর্ভধারণের জন্য প্রয়োজনীয় রক্ত সরবরাহ ও পুষ্টির ব্যবস্থা তৈরি করা, যার ফলে শারীরিক শক্তির স্তর কমে যেতে পারে। পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া, নোট্রিশনাল অভাব বা স্ট্রেসও ক্লান্তির কারণ হতে পারে।প্রেগন্যান্সি যদি প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে এবং ক্লান্তি অনুভব করেন, তবে এটি স্বাভাবিক।
মূত্রত্যাগের হার বৃদ্ধি (Frequent Urination)
প্রেগন্যান্সির সময় মূত্রত্যাগের হার বৃদ্ধি পেতে পারে। প্রথমে, গর্ভাবস্থায় হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে মূত্রাশয়ের ওপর চাপ বেড়ে যায়, ফলে মূত্রত্যাগের প্রবণতা বাড়তে পারে। এছাড়াও, গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধি ও বাচ্চার চাপের কারণে মূত্রাশয়ে চাপ পড়ে এবং মূত্রত্যাগের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।গর্ভাবস্থার প্রথম কয়েক মাসে এই লক্ষণটি বেশি লক্ষ্য করা যায়, এবং পরবর্তীতে, গর্ভের আয়তন বাড়ার সাথে সাথে আবার কিছুটা কমে যেতে পারে। তবে, যদি মূত্রত্যাগের হার খুব বেশি বেড়ে যায় বা অস্বস্তি অনুভূত হয়।
মাথাব্যথা (Headaches)
প্রেগন্যান্সির প্রথমদিকে মাথাব্যথা একটি সাধারণ লক্ষণ হতে পারে। হরমোনাল পরিবর্তন, শারীরিক অস্বস্তি, অতিরিক্ত চাপ, বা পর্যাপ্ত পানি না খাওয়ার কারণে এটি হতে পারে। এছাড়াও, গর্ভাবস্থায় রক্তচাপ কমে যেতে পারে, যা মাথাব্যথা সৃষ্টি করতে পারে। তবে, যদি মাথাব্যথা অনেক বেশি হয় বা নিয়মিত হয়ে থাকে, তাহলে একজন ডাক্তারকে পরামর্শ নেয়া উচিত, কারণ এটি অন্য কোনো শারীরিক সমস্যার কারণে হতে পারে। নারীরা বিভিন্ন সময়ে মাথাব্যথা অনুভব করতে পারেন, বিশেষত প্রথম trimester-এ।
ঘ্রাণ বা স্বাদে পরিবর্তন (Changes in Taste and Smell)
প্রেগন্যান্সির সময় ঘ্রাণ এবং স্বাদে পরিবর্তন হওয়া একটি সাধারণ লক্ষণ। এটি হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে ঘটে, বিশেষ করে প্রোগেস্টেরন এবং এইচসিজি (হিউম্যান কোরিয়নিক গোনাডোট্রপিন) হরমোনের প্রভাবের জন্য। কিছু মায়ের জন্য, তারা বিশেষ কিছু খাবারের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতে পারে, আবার কিছু খাবার বা গন্ধ তাদের অস্বস্তি বা বমি ভাব সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও, স্বাদের পরিবর্তন হতে পারে—যেমন অস্বাভাবিকভাবে মিষ্টি বা টক খাবারের প্রতি আকর্ষণ অথবা মাংস বা অন্য কোনো খাবারের প্রতি অরুচি। ঘ্রাণের প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা তো অনেকেরই দেখা যায়, যেমন তাজা খাবারের গন্ধ বা রান্নাঘরের গন্ধে অসন্তুষ্টি।
মেজাজের পরিবর্তন (Mood Swings)
প্রেগন্যান্সির সময় মেজাজের পরিবর্তন হওয়া একদম সাধারণ একটি লক্ষণ। হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে শরীরে নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটে, যা মেজাজে প্রভাব ফেলতে পারে। কিছু মহিলা এই সময়ে দুঃখ, উদ্বেগ বা আবেগের ওঠানামা অনুভব করেন, আবার কেউ কেউ অতিরিক্ত আনন্দিত বা উদাসীন হতে পারেন। এটি সাধারণত হরমোনের কারণে, যেমন প্রোজেস্টেরন এবং এস্ট্রোজেনের পরিমাণে পরিবর্তন। এর ফলে ব্রেনের কেমিক্যালস যেমন সেরোটোনিন এবং ডোপামিনের মাত্রাও প্রভাবিত হতে পারে। তবে, যদি মেজাজের পরিবর্তন খুব বেশি তীব্র বা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে একজন ডাক্তার বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
পেটে ব্যথা বা অস্বস্তি (Abdominal Discomfort)
প্রেগন্যান্সির শুরুতে অনেক মহিলার পেটে ব্যথা বা অস্বস্তির অনুভূতি হতে পারে, যা সাধারণত হরমোনাল পরিবর্তন এবং গর্ভাশয়ের প্রসারণের কারণে ঘটে। তবে, এই ধরনের ব্যথা বা অস্বস্তি সব সময়ই প্রেগন্যান্সির লক্ষণ নয়, কারণ অনেক কারণে পেটে ব্যথা হতে পারে, যেমন গর্ভাশয়ের প্রসারণ গর্ভধারণের প্রথম দিকে গর্ভাশয় প্রসারিত হতে থাকে, যা পেটে বা তলপেটে অস্বস্তি বা ব্যথার সৃষ্টি করতে পারে। হরমোনাল পরিবর্তন গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তনও পেটের কিছু অস্বস্তির কারণ হতে পারে। এগজিস্টিং পেটের সমস্যা অনেক সময় গ্যাস্ট্রিক, অ্যাসিডিটি বা পেটের অন্যান্য সমস্যা থেকেও পেটে ব্যথা হতে পারে।
ত্বকের পরিবর্তন (Skin Changes)
প্রেগন্যান্সির সময় ত্বকে কিছু পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। এই পরিবর্তনগুলো সাধারণত হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে ঘটে এবং প্রত্যেক নারীর ক্ষেত্রে আলাদা হতে পারে। কিছু সাধারণ ত্বকের পরিবর্তন হলো গা dark দাগ বা মেলাজমা প্রেগন্যান্সির সময় অনেক মহিলার গাল, নাক এবং কপালে গা dark ় দাগ বা মেলাজমা দেখা যায়। এটি মূলত হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে ঘটে। হালকা বা গা dark রেখা (Linea Nigra) অনেক মহিলার পেটের নিচের দিকে একটি গা dark রেখা দেখা যায়, যা সাধারণত গর্ভাবস্থার শেষ দিকে চলে।
চামড়ার শুষ্কতা প্রেগন্যান্সির সময় হরমোনের পরিবর্তনের কারণে ত্বক শুষ্ক হতে পারে এবং এর ফলে চুলকানি বা ফাটল হতে পারে। এলার্জি বা ব্রেকআউট কিছু মহিলার ত্বক প্রেগন্যান্সির সময় ব্রেকআউট বা এলার্জি প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। বিশেষত মুখে ব্রণ হতে পারে। সুগন্ধী বা ত্বকের উজ্জ্বলতা কিছু মহিলার ত্বক প্রেগন্যান্সির সময় বেশি উজ্জ্বল বা ঝকঝকে মনে হতে পারে, কারণ রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধি পায়। সেলফ প্রোডাকশন বা স্ট্রেচ মার্কস গর্ভাবস্থায় ত্বক প্রসারিত হয়, ফলে স্ট্রেচ মার্কস দেখা দিতে পারে, বিশেষ করে পেট, বুক বা কুঁচকিতে।
শরীরের তাপমাত্রার পরিবর্তন (Changes in Body Temperature)
প্রেগন্যান্সির প্রথম কিছু সপ্তাহে শরীরের তাপমাত্রা কিছুটা পরিবর্তিত হতে পারে। অনেক গর্ভবতী নারী প্রথম দিকে একটু বেশী গরম অনুভব করতে পারেন, বিশেষত সকালে বা রাতে। এই তাপমাত্রার পরিবর্তন মূলত হরমোনের প্রভাবের কারণে হয়, বিশেষ করে প্রোজেস্টেরন হরমোনের কারণে। প্রোজেস্টেরন হরমোন গর্ভাবস্থায় বৃদ্ধি পায়, যা শরীরের তাপমাত্রা কিছুটা বৃদ্ধি করতে পারে।
অস্বাভাবিক পেটের গোলমাল বা কোষ্ঠকাঠিন্য (Digestive Issues)
প্রেগন্যান্সির সময় পেটের গোলমাল বা কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে, এবং এটি বেশ সাধারণ একটি লক্ষণ। প্রেগন্যান্সির প্রথম ত্রৈমাসিকে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে পেটের নানা ধরনের সমস্যা যেমন গ্যাস, অস্বস্তি, কোষ্ঠকাঠিন্য, বা পেট ফোলা অনুভূত হতে পারে। হরমোন প্রোজেস্টেরন পেটের পেশীগুলিকে শিথিল করে, যার কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য বা পেটের গোলমাল হতে পারে।
উপসংহার
গর্ভাবস্থার লক্ষণগুলি খুবই ব্যক্তিগত এবং প্রতিটি নারীর জন্য আলাদা হতে পারে। তবে, উপরের তালিকাভুক্ত লক্ষণগুলির মধ্যে কোনটিই আপনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলে, আপনি গর্ভাবস্থার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে পারেন এবং ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে সঠিক পরীক্ষা করিয়ে নিশ্চিত হতে পারেন।