জবাবদিহিতা বলতে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডের জন্য তাদেরকে যে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয় তা বোঝায়। এই দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মাধ্যমে তারা তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য অন্যদের কাছে জবাবদিহি করতে হয়।
জবাবদিহিতা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। এটি একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য অপরিহার্য। জবাবদিহিতার মাধ্যমে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী থাকে এবং অন্যদের কাছে তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য জবাব দিতে হয়। এটি দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করে।
জবাবদিহিতার বিভিন্ন স্তর রয়েছে। ব্যক্তিগত জবাবদিহিতা বলতে ব্যক্তির নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য দায়িত্ববোধ বোঝায়। সামাজিক জবাবদিহিতা বলতে সমাজের অন্যান্য সদস্যদের কাছে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দায়িত্ব বোঝায়। রাজনৈতিক জবাবদিহিতা বলতে জনগণের কাছে সরকারের দায়িত্ব বোঝায়।
জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন উপায় রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন
- সুশাসন প্রতিষ্ঠা
- তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিতকরণ
- সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ
- নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি
জবাবদিহিতা একটি বহুলাংশে সাংস্কৃতিক ধারণা। এটি একটি সমাজ বা দেশের মানুষের মধ্যে দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যবোধের উপর নির্ভর করে। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন প্রয়োজন।
ব্যবসাযের প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা
ব্যবসায়ের প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা বলতে ব্যবসায়ের প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগ, শাখা বা কর্মচারীদের তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহিতা বোঝায়। অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ব্যবসায়ের প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কার্যক্রম সুষ্ঠু ও দক্ষভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয়।
ব্যবসায়ের প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন উপায় রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণ করা: ব্যবসায়ের প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগ, শাখা বা কর্মচারীদের জন্য স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণ করা জরুরি। এতে করে প্রত্যেক কর্মচারী তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করবে।
- নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন: ব্যবসায়ের প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগ, শাখা বা কর্মচারীদের কর্মকাণ্ড নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করা জরুরি। এতে করে প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাদের কর্মকাণ্ডের ফলাফল সম্পর্কে অবগত থাকতে পারবে এবং প্রয়োজনে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।
- সাংগঠনিক কাঠামো ও প্রক্রিয়া প্রণয়ন: ব্যবসায়ের প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক কাঠামো ও প্রক্রিয়া সুন্দরভাবে প্রণয়ন করা জরুরি। এতে করে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগ, শাখা বা কর্মচারীদের মধ্যে কার্যকর যোগাযোগ ও সমন্বয় নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
- প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন: ব্যবসায়ের প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন প্রদান করা জরুরি। এতে করে তারা তাদের কাজের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারবে এবং তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে আরও সচেতন হবে।
ব্যবসায়ের প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে নিম্নলিখিত সুবিধাগুলি অর্জন করা সম্ভব হয়:
- ব্যবসায়ের সাফল্য বৃদ্ধি: অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ব্যবসায়ের বিভিন্ন কার্যক্রম সুষ্ঠু ও দক্ষভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয়। ফলে ব্যবসার উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং লাভ বৃদ্ধি পায়।
- দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধ: অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ব্যবসায়ের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধ করা সম্ভব হয়।
- কর্মচারীদের মধ্যে উদ্দীপনা ও উৎসাহ বৃদ্ধি: অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে কর্মচারীদের মধ্যে উদ্দীপনা ও উৎসাহ বৃদ্ধি পায়। ফলে তারা তাদের কাজে আরও মনোযোগী হয় এবং উচ্চমানের কাজ করতে সক্ষম হয়।
সুতরাং, ব্যবসায়ের প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি ব্যবসার সাফল্য ও উন্নতির জন্য অপরিহার্য।
মালিক ঋণদাতা নিয়োগকারীদের নিকট জবাবদিহিতা
মালিক
শেয়ারহোল্ডারদের নিকট: শেয়ারহোল্ডাররা একটি ব্যবসায়ের মালিক। তাই মালিক হিসেবে তাদের কাছে জবাবদিহিতা থাকতে হয়। শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষা করা মালিকের প্রধান দায়িত্ব। এজন্য মালিককে ব্যবসার নীতিমালা ও পরিচালনা পদ্ধতি শেয়ারহোল্ডারদের সাথে আলোচনা করে গ্রহণ করতে হবে। শেয়ারহোল্ডারদের কাছে ব্যবসার আর্থিক অবস্থা, সাফল্য ও ব্যর্থতা সম্পর্কে নিয়মিত প্রতিবেদন দিতে হবে।
ব্যবসা পরিচালনার জন্য নিয়োজিত পরিচালকদের নিকট: ব্যবসা পরিচালনার জন্য মালিক পরিচালকদের নিযুক্ত করে থাকেন। তাই পরিচালকদের কাছেও মালিকের জবাবদিহিতা থাকে। পরিচালকদেরকে ব্যবসার নীতিমালা ও পরিচালনা পদ্ধতি মেনে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে। ব্যবসার আর্থিক অবস্থা, সাফল্য ও ব্যর্থতা সম্পর্কে মালিককে অবহিত করতে হবে।
ঋণদাতা
- ব্যাংক বা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিকট: ব্যবসার জন্য অর্থ প্রদানের জন্য মালিক ব্যাংক বা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারেন। তাই ঋণদাতাদের কাছেও মালিকের জবাবদিহিতা থাকে। ঋণদাতাদের প্রদত্ত অর্থের সুদ ও মূল্য পরিশোধ করতে হবে। ঋণদাতাদের সাথে চুক্তি অনুযায়ী ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে।
নিয়োগকারী
- কর্মচারীদের নিকট: ব্যবসার জন্য কর্মচারী নিয়োগ করা হয়। তাই কর্মচারীদের কাছেও মালিকের জবাবদিহিতা থাকে। কর্মচারীদের মজুরি, সুযোগ-সুবিধা, কর্মপরিবেশ ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে। কর্মচারীদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে।
সুতরাং, মালিক ঋণদাতা ও নিয়োগকারীদের নিকট জবাবদিহি থাকে। এই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ব্যবসার সাফল্য ও উন্নতি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
জবাবদিহি প্রক্রিয়ায় হিসাববিজ্ঞান
জবাবদিহি প্রক্রিয়ায় হিসাববিজ্ঞানের ভূমিকা
জবাবদিহিতা বলতে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডের জন্য তাদেরকে যে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয় তা বোঝায়। এই দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মাধ্যমে তারা তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য অন্যদের কাছে জবাবদিহি করতে হয়।
হিসাববিজ্ঞান হল আর্থিক তথ্যের সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ, বিশ্লেষণ ও যোগাযোগের একটি প্রক্রিয়া। হিসাববিজ্ঞান জবাবদিহি প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হিসাববিজ্ঞানের মাধ্যমে ব্যবসায়ের আর্থিক তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ করা হয়। এই তথ্যের মাধ্যমে ব্যবসায়ের মালিক, ঋণদাতা, নিয়োগকারী, সরকার ইত্যাদি বিভিন্ন পক্ষ ব্যবসার আর্থিক অবস্থা, সাফল্য ও ব্যর্থতা সম্পর্কে অবগত হতে পারে।
হিসাববিজ্ঞান জবাবদিহি প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে রয়েছে:
অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা: ব্যবসায়ের বিভিন্ন বিভাগ, শাখা বা কর্মচারীদের মধ্যে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য হিসাববিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হিসাববিজ্ঞানের মাধ্যমে ব্যবসায়ের বিভিন্ন বিভাগ, শাখা বা কর্মচারীদের কর্মকাণ্ডের ফলাফল নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করা হয়। এতে করে তারা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয় এবং তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী থাকে।
বাহ্যিক জবাবদিহিতা: ব্যবসায়ের মালিক, ঋণদাতা, নিয়োগকারী, সরকার ইত্যাদি বিভিন্ন পক্ষের কাছে ব্যবসার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য হিসাববিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হিসাববিজ্ঞানের মাধ্যমে ব্যবসার আর্থিক অবস্থা, সাফল্য ও ব্যর্থতা সম্পর্কে একটি সুনির্দিষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য তথ্য প্রদান করা হয়। এতে করে এই পক্ষগুলি ব্যবসার কার্যক্রম সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করতে পারে এবং ব্যবসার সাথে সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।
হিসাববিজ্ঞান জবাবদিহি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিম্নলিখিত সুবিধাগুলি অর্জন করা সম্ভব হয়:
দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধ: হিসাববিজ্ঞানের মাধ্যমে ব্যবসায়ের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধ করা সম্ভব হয়। হিসাববিজ্ঞানের মাধ্যমে ব্যবসায়ের আর্থিক তথ্য সুনির্দিষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে সংরক্ষণ করা হয়। এতে করে ব্যবসায়ের বিভিন্ন পক্ষ ব্যবসার আর্থিক তথ্যের সঠিকতা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে। ফলে দুর্নীতি ও অনিয়মের সুযোগ কমে যায়।
ব্যবসায়ের সাফল্য ও উন্নতি: হিসাববিজ্ঞানের মাধ্যমে ব্যবসার সাফল্য ও উন্নতি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। হিসাববিজ্ঞানের মাধ্যমে ব্যবসার আর্থিক অবস্থা, সাফল্য ও ব্যর্থতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করা যায়। এই ধারণার ভিত্তিতে ব্যবসার কার্যক্রম পরিচালনা করা হলে ব্যবসার সাফল্য ও উন্নতি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
সুতরাং, হিসাববিজ্ঞান জবাবদিহি প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হিসাববিজ্ঞানের মাধ্যমে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। ফলে ব্যবসায়ের সাফল্য ও উন্নতি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
(ক) সততা ও দায়িত্ববোধের বিকাশঃ হিসাবরক্ষন ক্ষেত্রে হিসাববিজ্ঞানের রীতি -নীতি ও কলাকৌশল যথাযথভাবে অনুসরণ করা হলে আর্থিক দুর্নীতি, জালিয়াতি, সম্পদ ইত্যাদির ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে এবং হিসাব এর সত্যত হিসাবের সততা স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পায়। আর বছরের পর বছর অনুসরণের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্ববোধ বিকশিত হয় ।
(খ) ঋণ পরিশোধ সচেতনতা সৃষ্টিঃ হিসাববিজ্ঞান ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ঋণ পরিশোধে সচেতনতা সৃষ্টি করে এবং তাদের মূল্যবোধ জাগ্রত করে। ফলে ঋণখেলাপি হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পায় ।
(গ) ধর্মীয় মূল্যবধ সৃষ্টিঃ সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও প্রয়োজনীয় ব্যয় পরিহার ধর্মীয় মূল্যবোধের অংশ। সঠিক হিসাব সংরক্ষণ করলে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে আয় বুঝে ব্যয় করার মানসিকতা সৃষ্টি ও সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হয়।
(ঘ) সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ববোধ সৃষ্টিঃ সরকারের আয়ের অন্যতম উৎস গুলো হচ্ছে ভ্যাট কাস্টমস ডিউটি আয়কর প্রভৃতি। হিসাববিজ্ঞানের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে সঠিক আয় ও ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ফলে কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা হ্রাস পায়।
(ঙ) জালিয়াতি ও প্রতারণা প্রতিরোধঃ সুষ্ঠূ হিসাবব্যবস্থা প্রচলিত থাকলে সম্ভাব্য শাস্তি ও দুর্নামের ভয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী কর্মকর্তাদের মধ্যে জালিয়াতি, তহবিল তছরু, প্রতারণাসহ বিভিন্ন অনিয়মের প্রবণতা হ্রাস পায়।