উপন্যাস কাকে বলে? – উপন্যাসের আঙ্গিক ও গঠনকৌশল

উপন্যাস হলো আখ্যানমূলক কল্পকাহিনি বা উপাখ্যানের তুলনামূলকভাবে বর্ধিত একটি রচনা যেখানে লেখক তাঁর জীবনদর্শনকে বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে চিত্রায়ন করেন, যা সাধারণত গদ্যে লেখা হয় এবং একটি বই হিসাবে প্রকাশিত হয়।

উপন্যাস একটি সংস্কৃত শব্দ যার অর্থ “সুবিন্যস্ত”, এর ব্যুৎপত্তিগত বিশ্লেষণ হচ্ছে উপ+নি+অস্‌+অ, যেখানে উপ- (“বিশেষ” অর্থে) উপসর্গের সঙ্গে ন্যাস (“বিন্যাস”) শব্দটি যুক্ত হয়েছে।

উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর বিস্তৃততা। উপন্যাসের কাহিনী সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সময়কালে ও একটি নির্দিষ্ট স্থানে ঘটে। উপন্যাসে অনেকগুলি চরিত্র থাকে, যাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সম্পর্ক থাকে। উপন্যাসের কাহিনীতে সাধারণত একটি বা একাধিক সংঘাত থাকে, যা চরিত্রদের বিকাশ ও পরিবর্তন ঘটায়।

উপন্যাসের প্রধান উপাদানগুলি হলো:

    • কাহিনী: উপন্যাসের মূল উপাদান হলো কাহিনী। কাহিনী হলো উপন্যাসের একটি সুবিন্যস্ত ও সুসংগঠিত বিন্যাস, যাতে চরিত্র, ঘটনা ও স্থানের মধ্যে একটি জটিল সম্পর্ক থাকে।
    • চরিত্র: উপন্যাসে অনেকগুলি চরিত্র থাকে, যাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সম্পর্ক থাকে। চরিত্রগুলি উপন্যাসের কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
    • ঘটনা: উপন্যাসে বিভিন্ন ধরনের ঘটনা ঘটে, যা চরিত্রদের পরিবর্তন ও বিকাশ ঘটায়।
    • স্থান: উপন্যাসের ঘটনা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সময়কালে ও একটি নির্দিষ্ট স্থানে ঘটে।
    • ভাষা: উপন্যাসের ভাষা সাধারণত সুন্দর ও চিত্তাকর্ষক হয়।

উপন্যাসের শ্রেণীবিভাগ

উপন্যাসের বিভিন্ন ধরনের শ্রেণীবিভাগ রয়েছে। কিছু সাধারণ শ্রেণীবিভাগ হলো:

    • বিষয়বস্তু অনুযায়ী: উপন্যাসগুলিকে তাদের বিষয়বস্তু অনুযায়ী বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন, সামাজিক উপন্যাস, রোমান্টিক উপন্যাস, ঐতিহাসিক উপন্যাস, গোয়েন্দা উপন্যাস, বিজ্ঞান কল্পকাহিনী উপন্যাস ইত্যাদি।
    • দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী: উপন্যাসগুলিকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন, প্রথম ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি, তৃতীয় ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি, অজ্ঞাতনামা দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি।
    • কাহিনীর গতি অনুযায়ী: উপন্যাসগুলিকে তাদের কাহিনীর গতি অনুযায়ী বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন, ধীরগতির উপন্যাস, দ্রুতগতির উপন্যাস, মধ্যগতির উপন্যাস ইত্যাদি।

উপন্যাসের গুরুত্ব

উপন্যাস একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক ধারা। উপন্যাস মানুষের জীবন, সমাজ ও সংস্কৃতির একটি বাস্তব ও চিত্তাকর্ষক চিত্র তুলে ধরে। উপন্যাস মানুষের চিন্তাভাবনা ও অনুভূতিকে প্রভাবিত করে। উপন্যাস মানুষের সৃজনশীলতা ও কল্পনাশক্তিকে বিকাশে সাহায্য করে।

গণমুখীতা উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য ।  সে কারণে বিচিত্র ধারায় উপন্যাসের ক্রমবিকাশ ঘটেছে দূততার সাথে ।  আধুনিক যুগে সমাজ ও প্রকৃতির বিরুদ্ধে ব্যক্তি মানুষের যে সংগ্রাম তারই মহাকাব্যিক  রূপ উপন্যাস । এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় Ralph Fox-এর উক্তি

The Novel is the epi -form of our modern, bourgeois society,  it did not exist except in very rudimentary  form before that moder civilisation which began with the renaissance and like every new art from it has served its purpose extending human consciousness.

 

উপন্যাসের আঙ্গিক ও গঠনকৌশল

সাহিত্যের একটি সমৃদ্ধ শাখা উপন্যাস ।সাহিত্যের অন্যান্য শাখার তুলনায় উপন্যাস তুলনামূলকভাবে আধুনিককালের সৃষ্টি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ কবিতা বলেছেন, ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি।

এই আবেগকে বাস্তব রূপ দিতে গিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও স্বরূপ অনুভূতির লেখা রং – রেখা  শব্দ রূপকের সাহায্য লেখক-সাহিত্যিক অন্যের কাছে প্রকাশ করেন ।

উপন্যাসের উদ্দেশ্য – উপন্যাসিক জীবনের যে আলেখ্য দেখেছেন তার বর্ণাঢ্যতা পাঠক হৃদয়ে সঞ্চারিত করা । উপন্যাসের গঠন রীতি সম্পর্কে উপন্যাসিক শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেন উপন্যাসিকের পক্ষে কতগুলো চরিত্র এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা ।

একটি বিশেষ প্রয়োজনীয় অন্যান্য গ্রন্থকারের যা বিপদ প্লট পায় না সেই সম্বন্ধে আমাকে কোনদিন চিন্তা করিতে হয় নাই ।

কতগুলি চরিত্র ঠিক নেই, তাহাদিগকে পটাবার জন্য যা দরকার তা আপনি আশিয়া পড়ে । আসল জিনিস কতকগুলি জড়িত তাদের সবার জন্য প্লটের দরকার তখন পারিপার্শ্বিক অবস্থা আনিয়া যোগ দিতে হয় ।

সুতরাং উপন্যাসিক যে সুবিহিত ও সামঞ্জস্য ঘটনাবিন্যাসের সাহায্য চরিত্র সৃষ্টিতে সহায়ক, হবেন, এটাই মুখ্য কথা । চরিত্র ও গঠন বিন্যাসের  মধ্য দিয়ে জীবন প্রবাহ সৃষ্টি হয় । পাত্র-পাত্রী  কথোপকথন উপন্যাসের পক্ষে বিশেষ প্রয়োজনীয় ।

সাবলীল সহজ সহজ ও স্বাভাবিক উপন্যাসের চরিত্র বিকাশে সহায়ক।

এছাড়া যে দেশের যে কালের সমাজের উপন্যাস লেখা হচ্ছে, সে দেশকাল সমাজে রুচি আচার ব্যবহার ও রীতি নীতি অনুযায়ী  যথাযোগ্য পটভূমি নির্বাচন ও চিত্র অংকন প্রচেষ্টা ও উপন্যাসের চলতে পারে।

কোনো কোনো  উপন্যাসিক বিশেষ কোনো স্থান বা জেলা অধিবাসীদের আচার-ব্যবহার বা জীবনযাত্রা  আখ্যান  নিয়ে উপন্যাস রচনা করেন। এ জাতীয় উপন্যাস এর স্থানীয় বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে বর্তমান থাকে।

সাহিত্যে বাণীরুপ  পায়  জগৎ  ও জীবনের প্রতিচ্ছবি । প্রতিফলিত হয় দেশ কাল ও সমাজের বাস্তব  রূপ । সাহিত্যের পাঠক সাহিত্য থেকে রসমাধুর্য উপভোগ করে, ফলে জীবন ও চারপাশের পরিচিত নতুন করে দেখার উপায়।

রচিত সাহিত্য যদি সাহিত্যিকের হাতের রসমধুর রূপ লাভ করে, তাহলে পাঠকের কাছে তা হয়ে ওঠে সীমাহীন আনন্দ সামগ্রী।

সর্বকালের সহৃদয়জনের ভাবকে আত্মগত করে  তা  পরের করে প্রকাশ করাই হল সাহিত্য। উপন্যাসের সংজ্ঞা ও গঠনকৌশল এর সামনে রেখে উপন্যাসতত্ত্ববিদ পন্ডিত সমালোচকরা উপন্যাসে পাঁচটি সূত্র বিবৃত করেছেন। 

 যেমন

                ❐   ১। প্রস্তাবনা

                ❐  ২। সমস্যার উপস্থাপনা

                ❐ ৩। আখ্যানভাগের মধ্যে জটিলতার প্রবেশ

                ❐ ৪।  চরম সংকট মুহূর্ত ও

                ❐ ৫।   সংকট বিমোচন বা উপসংহার

 

গোপন রীতি শব্দাবলী কথা চিন্তা করে ওষুধ খেতে মনে রাখতে হবে যে উপন্যাসকে অবশ্যই উপভোগ করতে হবে । বিশ্ব ইংরেজি সাহিত্যে সাহিত্য সভা উইলিয়াম সমারসেট মম ( William Somerset Maugham) যথার্থই বলেছেন ।

Finally a novel should be entertaining it is an essential quality without which no other quality is of any use একথা ঠিক । বাস্তবিক উপন্যাস হবে উপভোগ আনন্দ সঞ্চারকারী ও আনন্দদানকারী । উপন্যাস মূলত আনন্দ সামগ্রী,  আনন্দের সাথে ।

বাংলা উপন্যাসের জন্মকথাঃ ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রভাবে বাংলা উপন্যাসের উদ্ভব ঘটে ।  বাংলা সাহিত্য উপন্যাস বৃষ্টির প্রথম প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় ভবানীচরন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নববাবু বিলাস এ ১৮২৫ এরপর হ‍্যানা ক্যাথেরিন মুলেন্স ফুলমনি ও করুণার বিবরণ এ ১৮৫১ উপন্যাসের ইঙ্গিত আরও স্পষ্টতর ।

এরপর ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত প্যারিচাঁদ মিত্রের আলাপের ঘরের দুলাল বাংলা উপন্যাসে ধারায় একটি স্মরণীয় গ্রন্থ । আলালের ঘরের দুলাল তাই বাংলা উপন্যাসের ধারায় প্রথম উপন্যাস ।

তবে প্রথম সার্থক বাংলা উপন্যাসের বলতে হবে বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশ নন্দিনীর ১৮৬৫ কথা ।  এরপর বঙ্কিমচন্দ্রের অন্যান্য উপন্যাস যেমন কপালকুণ্ডলা চন্দ্রশেখর আনন্দমঠ দেবী চৌধুরানী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ।

বঙ্কিমচন্দ্রের হাতেই বাংলা উপন্যাস পরিপূর্ণ অবয়ব লাভ করে নানাভাবে বিকশিত হয় । পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অপরাজের কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিমূর্তভূষণ বন্দোপাধ্যায় তারাবংশকর চট্টোপাধ্যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বিমল মিত্র প্রমূখ শিল্পী বাংলা উপন্যাসকে সমৃদ্ধ শ্রীবৃদ্ধি করেছেন ।

 বাংলাদেশের উপন্যাসের বৈশিষ্ট্যঃ বাংলা উপন্যাসের গৌরবান্বিতঐতিহ্য অনুসরণ করে এই বাংলাদেশের উপন্যাসের বিকাশ ঘটেছে ।  তবে গতানুগতিক বৈশিষ্ট্যর আলোকে বাংলাদেশের উপন্যাসিকগণ নিজেদের প্রতিভা নিয়োজিত করেননি; বরং তারা পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে উপন্যাসের নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য পরিচয় প্রকাশ করেছেন । 

বাংলাদেশের গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের বিচিত্র রূপ মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ-দুঃখ ও হাসি উল্লাস সামাজিক রাজনৈতিক জিজ্ঞাসা আঞ্চলিক জীবনচিত্র মনস্তত্ব ঐতিহাসিক চেতনা ইত্যাদি নানা বিষয় এখানকার উপন্যাসের অপজিব্য ।  সংখ্যায় ও বিষয়বৈচিত্র্যে এখানকার উপন্যাস উল্লেখযোগ্য স্বতন্তে সমুজ্জ্বল ।

বাংলাদেশের উপন্যাস ও ঔপন্যাসিকঃবিভাগোওর বাংলাদেশের স্বরতন্ত্র পরিবেশ উপন্যাস সৃষ্টির বিপুল সম্ভাবনা দেখা যায় ।  ফলে এখানকার কথাসাহিত্যের  ধারায় উপন্যাস সৃষ্টি করেছে এক আলোড়ন ।

 এখানাকার প্রথম শারির ঔপন্যাসিকগণের তালিকায়য়ে দেখা যায় আবুল হাসেম খান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আবুল  ফজল আবুল মনসুর আহমদের সত্যমিথ্যা  জীবনক্ষুধা  আবেহায়ত প্রভৃতি উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য সংযোজন । 

প্রবীণ ঔপন্যাসিক মাহাবুব উল আলমের মোমেনের জবানবন্দি ।

উপন্যাস সাহিত্যে মুসলিম লেখকঃ বাংলা সাহিত্যের উপন্যাস ক্ষেত্রে মুসলিম লেখকদের প্রাথমিক প্রচেষ্টা স্বাভাবিক শিল্প চেতনায় স্বার্থক নয় । 

এর ক্ষেত্রে মীর মোশারফ হোসেন  মোজাম্মেল হক মজিবর রহমান ইসমাইল হোসেন সিরাজী বেগম রোকেয়া কাজিনদাদুল হক শেখ ফজলুল করিম মোঃ লুৎফুর রহমান আরজুমান্দু আলী  শাহাদাত হোসেন কাজী আব্দুল ওদুদ কাজী নজরুল ইসলাম আকবর উদ্দিন মাহবুবুল আলম ও হুমায়ুন কোভিদ সকলেই উপন্যাস রচনায় হাত দিয়েছিলেন ।

তাদের সবার উপন্যাস সার্থকক শিল্পকর্ম না হলেও সাহিত্যিক দিক থেকে মূল্য অনেক বেশি ।  তারা পরবর্তীকালের উপন্যাস রচনার প্রেক্ষাপট  শক্তভাবে  কড়ে দিয়েছেন ।

বাংলাদেশের উপন্যাসের পথযাত্রাঃ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে । তাই বলে বাংলাদেশের উপন্যাস বলতে 1971 সালে পরবর্তী উপন্যাসকে শুধু বোঝায় না । 

১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর থেকেই মূলত বাংলাদেশের উপন্যাসের পদযাত্রা ।  দেশ বিভাগের পর পূর্ব বাংলায় যে ধরনের মানবিকতা জীবনবোধ আচার আচরণ চিন্তা চেতনার বিকাশ ঘটে তার ওপর ভিত্তি করে যে উপন্যাস রচিত হয়, তাকে বাংলাদেশের উপন্যাস বলে অভিহিত করতে চাই আমরা ।

পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশ মুসলিম  অধ্যুষিত অঞ্চল ।  কলকাতা কেন্দ্রিক বাংলার উপন্যাসে মুসলিম জীবন উপেক্ষিত ।  উপন্যাসে মুসলিম জীবনচিত্র  মুসলিম জীবনে অনুষঙ্গ ও ধর্মীয় অনুভূতি। শিক্ষা সংস্কৃতি স্থান পায়নি ।

তাই সেসব উপন্যাসে শিল্প মহিমা থাকলেও বৃহৎ মুসলিম জনগোষ্ঠীর জীবনবোধ সেখানে অনুপস্থিত । যে কারণেই মুসলমান জীবনের আলোকে  পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের যে জীবনসত্যকে উপন্যাসে ফুটিয়ে তুলেছেন আমরা সেসব উপন্যাসকে বাংলাদেশের উপন্যাস বলে আলোচনা করব ।

 

বাংলাদেশের বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক

আবু ফজল (১৯০৩–১৯৮৩)ঃবাংলাদেশের স্বনামধন্য প্রাবন্ধিক ও বিশিষ্ট চিন্তাবিদ । শিল্প বিচারের মাপকাঠিতে আবুল যফফারের উপন্যাসিক কৃতিত্ব যতটা না গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ তিনি মানবতাবাদী সমাজতন্ত্রের প্রচারক ও সাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গির জন্য তিনি সকল মানুষের শ্রদ্ধার্ঘ্য মানুষ ।

সত্যেন সেন (১৯০৭–১৯৮১)ঃ ৭১এর আগের বাংলাদেশের উপন্যাসের আলোচনায় সত্যেন সেন একটি অপরিহার্য নাম । তিনি অনেকগুলো স্বার্থক উপন্যাস রচনায় কৃতিত্ব দেখিয়েছেন ।

দীর্ঘ বন্ধী জীবনের বিচ্ছিন্ন জীবনবোধকে তিনি পূর্ণ করে তুলেছেন তার উপন্যাস সৃষ্টির ঐকআগ্রতা দিয়ে ।তিনি প্রেমের ঘটনা দিয়ে শুরু করে বন্দী জীবনের অভিজ্ঞতা এবং শ্রেণী সংগ্রাম চেতনার উপন্যাসের  শিল্পোওরণ ঘটিয়েছেন ।

তাঁর রচিত উপন্যাসসমূহ ভোরের বিহঙ্গী বুদ্ধদার মুক্তপ্রাণ সাত নম্বর ওয়ার্ডে পদচিহ্ন সেয়ানা অভিশপ্ত নগরী পাপের সন্তান বিদ্রোহী কৈবর্ত পুরুশ মেধ   কুমার জীব আলবেরুনী ইত্যাদি উপন্যাস বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে ।

শওকত ওসমান(১৯১৭–১৯৯৭)ঃবাংলাদেশের উপন্যাস সাহিত্যে প্রতিভাবান পুরুষ ।  সমাজচেতনা  শিল্পচেতনা  এবং জীবনবোধের  রূপায়ণ তাঁর উপন্যাসকে বিশিষ্টতা দান করেছে । জননী তার প্রথম উপন্যাস । 

পল্লীজীবন  পল্লির পরিবেশ এবং পল্লির নিয়ে রচিত তাঁর এ উপন্যাস । ক্রীত দাসের হাসি সমাগত চৌরসন্ধি রাজা উপাখ্যান প্রবৃত্তি উপন্যাস ওসমানের প্রতিভার সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন

 

উপন্যাসের শ্রেণীবিভাগ

উপন্যাস বিভিন্ন শ্রেণি হতে থাকে । উপন্যাস কখনো  কাহিনীনির্ভর  মনস্তাত্ত্বিক কখনো থামনীতিক থামূলক  আবার কখনো বক্তব্যেধনী হয়ে থাকে।

তবে যে রকমই হোক না কেন সার্থক উপন্যাস সৃষ্টি করতে পারে সংগঠনগুলিকে বিশ্বস্ততার অনুসরণ করতে হয়। বিষয় চরিত্র প্রবণতা ও গঠনগত সৌকর্যের ভিত্তিতে উপন্যাসকে নানা শ্রেণীতে ভাগ করা যায়।  যেমন-

একাওর সালে যুদ্ধ চলাকালীন শওকত ওসমান পাড়ি জামান যুক্তরাষ্ট্রের ।  সেখানে তিনি রচনা করেন  জাহান্নাম হতে বিদায় উপন্যাসটি ।  তৎসময়ের সকল বিবেকবান মানুষের প্রাথমিক মানসিকতা এ উপন্যাসের প্রতিফলিত হয়েছে ।

ঐতিহাসিক উপন্যাসঃ  ইতিহাস অবলম্বন করে যে বন্যা সূচিত হয় তাকে অতি হাসি উপন্যাস বলে ।

এজাতীয় উপন্যাসে উপন্যাসিক সমসাময়িক জীবনের বিষয়বস্তু নিয়ে উপন্যাস রচনা করেন না। তিনি অতীতমুখী অতীতের কাহিনীকে উপন্যাসে প্রাণবান করে তোলেন।

ঐতিহাসিক উপন্যাসিক কে অতীত জীবনের ইতিহাস অতীতের রীতিনীতি প্রভৃতির সম্বন্ধে সচেতন থাকতে হয় তা না হলে তার উপন্যাস কালবিরোধ-দোষ ঘটতে পারে এবং তিনি যে কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন তা ব্যর্থতার পর্যবসিত হয় ।

উপন্যাসের লেখকের সর্বোচ্চ সত্যের শৃংখলে আবদ্ধ নয় । তিনি ইচ্ছেমতো অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য কল্পনার  আশ্রয় নিতে পারেন । ঐতিহাসিক উপন্যাস সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন ইতিহাস পড়িব না আইভানহো পড়িব ।

 আবু রুশদ (১৯১৭–১৯৯৭)ঃ সামনে নতুন দিন  ডোবা হলো দিঘী নোঙর তার তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ।  দেশ বিভাগ এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠালগ্নকে  কেন্দ্রীয় করে রচিত নোঙর ।

সৈয়দ আলীউল্লাহ (১৯২২–১৯৭১)ঃদেশ বিভাগে অল্প পরে রচিত পূর্ব বাংলার ভালো উপন্যাসের মধ্যে অন্যতম ওয়ালিউল্লাহ লালসালু (১৯৪৮)উপন্যাসটি ।  এছাড়া তার চাঁদের  অমাবস্য(১৯৬৮)এবং কাঁদো নদী কাঁদো তার সার্থক সৃষ্টি ।

 সর্দার জয়নুদ্দিন(১৯১৮–১৯৮৬)ঃ নিষ্ঠাবান উপন্যাসিক হিসেবে তিনি অন্যতম । তাঁর আদিগন্ত উপন্যাসটি পূর্ব বাংলার গ্রামীণ জীবনের  পটভূমিতে রচিত । সমাজের নিম্ন শ্রেণীর মানুষের  ব্যথাডর্দীন জীবন কাহিনী নিয়ে রচিত পান্না মতি উপন্যাস ।

  নীলরঙ  রক্ত উপন্যাসে নীলকরদের অত্যাচার ও শোষণের কাহিনী বর্ণিত ।  অনেক সূর্যের আসা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং  স্বাধীনতাসংগ্রামের  বিস্তৃত পটভূমিকায় রচিত ।

  রশিদ করিম (১৯২৫–২০১১)ঃউত্তর পুরুষ তার প্রথম উপন্যাস । এ উপন্যাসের জন্য তিনি আদমজী সাহিত্য পুরস্কার পান । প্রসন্ন পাষাণ তার অন্য উপন্যাস ।

শহিদুল্লাহ  কায়সারঃ(১৯২৭-১৯৭১)বাংলাদেশের ঔপন্যাসিকদের মধ্যে অন্যতম তরুণ নিষ্ঠাবান উপন্যাসিক ।  সারেং বৌ সংশপ্তক বাংলা উপন্যাস জগতে উত্তম শিল্পকর্ম রূপে চিরন্তন হয়ে থাকবে ।

 শামসুদ্দিন আবুল কালাম(১৯২৬–১৯৯৭)ঃ তাঁর উল্লেখ্যযোগ্য উপন্যাস কাশবনের কন্যা ।  এ উপন্যাসে দেশের মাঝি সম্প্রদায়ের দুঃখ সুখের কথা তুলে ধরেছেন । 

তার অন্য উপন্যাস আলমনগরের উপকথা পীর বংশের শাসন ক্ষমতা দখলের কাহিনী উপন্যাসটিকে বিশিষ্টতা দান করেছে ।  এছাড়া কাঞ্চনমালা বেদে জীবনের  উপজীব্য কাহিনী নিয়ে রচিত ।

 আবু ইসহাক(১৯২৬–২০০৩)ঃসূর্য দীঘল বাড়ি তার বিখ্যাত উপন্যাস । এর উপন্যাসে বাংলাদেশের অশিক্ষিতসহ চাষীদের জীবন বৃত্তান্ত জীবন্ত করে অংকন করেছেন তিনি ।বাংলাদেশের কৃষক জীবনে মাটি  গন্ধ এ উপন্যাসের প্রভাসিত রূপ ।

 আনোয়ার পাশাঃ (১৯২৮–১৯৭১)ঃ বক্তিগত জীবনের দেশ ভঙ্গের তীক্ত অভিজ্ঞতা আনোয়ার পাশার উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু ।  নীড় সন্ধানী নিশুতি রাতের গাঁথা রাইফেল রোটি আওরাত তার রচিত উপন্যাস ।  রাইফেল রোটি আওরাত উপন্যাসে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব বর্ণনা ভরপুর

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top