জাতিসংঘের সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক সিটিতে অবস্থিত। এটি ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সালের মধ্যে নির্মিত হয়। এই সদর দপ্তরটি একটি আন্তর্জাতিক অঞ্চল হিসেবে গণ্য করা হয়, যা জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলির মালিকানার অধীনে রয়েছে।
জাতিসংঘের সদর দপ্তরটি একটি বিশাল কমপ্লেক্স যা বিভিন্ন ভবন নিয়ে গঠিত। এই ভবনগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- সাধারণ পরিষদ ভবন
- নিরাপত্তা পরিষদ ভবন
- অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ ভবন
- সচিবালয় ভবন
- দ্যাগ হ্যামারশোল্ড লাইব্রেরী
জাতিসংঘের সদর দপ্তরটি বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক স্থান। এটি বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা ছিল জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান প্রেক্ষাপট। এই যুদ্ধে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ নিহত হয় এবং বিপুল পরিমাণ সম্পদ ধ্বংস হয়। এই যুদ্ধের ফলে বিশ্ববাসী বুঝতে পারে যে, যুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা অর্জন করা সম্ভব নয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, মিত্রশক্তির মধ্যে একমত হয়েছিল যে, যুদ্ধের পর একটি বিশ্ব সংস্থা গঠন করা হবে যা বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করবে। এই লক্ষ্যে, ১৯৪২ সালের ১ জানুয়ারি, ওয়াশিংটনে ৫০টি দেশের প্রতিনিধিরা জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করে। এই ঘোষণাপত্রটি জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
১৯৪৫ সালের ২৫ এপ্রিল থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোতে জাতিসংঘের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে ৫১টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। এই সম্মেলনে জাতিসংঘের সনদ চূড়ান্ত হয়। ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর, ৫১টি দেশ জাতিসংঘ সনদ স্বাক্ষর করে। এই তারিখটি জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার দিন হিসেবে গণ্য করা হয়।
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করা। এছাড়াও, জাতিসংঘের উদ্দেশ্যগুলির মধ্যে রয়েছে:
- জাতিসমূহের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা
- আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা
- সামাজিক, মানবিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহায়তা করা
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এটি বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এছাড়াও, জাতিসংঘ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
তেহরান সম্মেলন
তেহরান সম্মেলন ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্যের নেতাদের মধ্যে একটি বৈঠক। এটি ১৯৪৩ সালের ২৮ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ইরানের তেহরানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট, সোভিয়েত প্রিমিয়ার জোসেফ স্ট্যালিন এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল উপস্থিত ছিলেন।
সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সামরিক এবং কৌশলগত নীতিগুলি নিয়ে আলোচনা করা। সম্মেলনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে রয়েছে:
- ১৯৪৪ সালের ১ জুনের মধ্যে পশ্চিম ইউরোপে দ্বিতীয় সোভিয়েত-জার্মানি সীমান্তে একটি দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার প্রতিশ্রুতি।
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিকে চারটি অংশে বিভক্ত করা হবে।
- ইতালিতে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার জন্য ইতালির সাথে জোট গঠন।
- জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের যোগদান।
তেহরান সম্মেলন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতিপথকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করেছিল। দ্বিতীয় ফ্রন্টের প্রতিশ্রুতি নাৎসি জার্মানির পরাজয়ের দিকে পরিচালিত করেছিল, এবং জাপানের বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের যোগদান যুদ্ধের পশ্চিম থিয়েটারে চাপ বাড়িয়েছিল। সম্মেলনটি মিত্র শক্তিদের মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয় এবং সহযোগিতাও বৃদ্ধি করেছিল।
ইয়াল্টা সম্মেলন
ইয়াল্টা সম্মেলন ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনীর প্রধান নেতাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত তৃতীয় প্রধান সম্মেলন। এটি ১৯৪৫ সালের ৪ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের কৃষ্ণসাগরের তীরে অবস্থিত ইয়াল্টা শহরে অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা জোসেফ স্ট্যালিন অংশগ্রহণ করেন।
ইয়াল্টা সম্মেলনের মূল লক্ষ্য ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী জার্মানি এবং ইউরোপের পুনর্গঠন সম্পর্কে আলোচনা করা। এছাড়াও, জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের যোগদানের বিষয়েও এই সম্মেলনে আলোচনা করা হয়।
ইয়াল্টা সম্মেলনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:
- জার্মানিকে চারটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হবে এবং এই অঞ্চলগুলির প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ফ্রান্সের মধ্যে ভাগ করা হবে।
- জার্মানিকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং এই ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য একটি কমিশন গঠন করা হবে।
- পোল্যান্ডের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা হবে এবং পোল্যান্ডে একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করা হবে।
- জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করা হবে।
- জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন যোগদান করবে।
ইয়াল্টা সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী বিশ্বের গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সম্মেলনের মাধ্যমে মিত্রবাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী বিশ্বের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করে।
ইয়াল্টা সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলির মধ্যে কিছু সিদ্ধান্ত অত্যন্ত বিতর্কিত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জার্মানির চার ভাগে বিভক্তকরণ এবং পোল্যান্ডের সীমানা পুনর্নির্ধারণের সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তগুলির ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী ইউরোপে শীতল যুদ্ধের সূত্রপাত হয়।
জাতিসংঘ সনদ
জাতিসংঘ বিশ্বের জাতিসমূহের একটি সংগঠন যার মূল লক্ষ্য আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্য জাতিসংঘ গঠিত হয়।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে জুন বিশ্বের ৫০ টি দেশের প্রতিনিধিরা যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোতে ১১১ ধারা সম্বলিত জাতিসংঘের মূল সনদে স্বাক্ষর করেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ অক্টোবর ৫১ তম দেশ হিসেবে পোল্যান্ড জাতিসংঘ সনদে (United Nations Charter ) স্বাক্ষর করে।
১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ একান্নটি সদস্য দেশ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘ সনদ কার্যকর হওয়ার পূর্বেই পোল্যান্ড সনদে স্বাক্ষর করে বলে পোল্যান্ডকে ওজাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাতা দেশ হিসেবে গণ্য করা হয়।
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ সনদ কার্যকর হয়। এজন্য প্রতিবছর ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ দিবস হিসেবে পালিত হয় ।
জাতিসংঘের পতাকা
জাতিসংঘের পতাকা আছে হালকা নীলের ওপর সাদা রংয়ের জাতিসংঘের প্রতীক। জাতিসংঘের প্রতীকের মাঝখানে পৃথিবীর মানচিত্র দুই পাশে দুইটি জলপাই গাছের শাখা। জলপাই গাছ শান্তির প্রতীক ।
জাতিসংঘের সদর দপ্তর ও দাপ্তরিক ভাষা
১। সদর দপ্তর ম্যানহাটন , নিউইয়র্ক , যুক্তরাষ্ট্র
২। ইউরোপীয় দপ্তর জেনেভা , সুইজারল্যান্ড
৩ । দাপ্তরিক ভাষা জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা কয়টি যথা-
ইংলিশ, চীনা , স্প্যানিশ , ফরাসি , রুশ , আরবি
জাতিসংঘের সদস্যপদ
জাতিসংঘের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১৯৩। ২০১১ সালের ১৪ জুলাই ১৯৩০০ তম সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে দক্ষিণ সুদান যোগ দান করে। জাতিসংঘের প্রাক্তন সদস্য রাষ্ট্র তাইওয়ান ।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ২৫ অক্টোবর গণচীন জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং তাইওয়ানকে জাতিসংঘ হতে বহিষ্কার করা হয় । ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ২০ জানুয়ারি ইন্দোনেশিয়া জাতিসংঘ হতে নিজে কে প্রত্যাহার করে নেয়।
১৯৬৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ইন্দোনেশিয়া পুনরায় জাতিসংঘে যোগদান করে । ক্ষেত্র জাতি সংঘের বৃহত্তর সদস্য দেশ আয়তনে রাশিয়া জনসংখ্যা চীন জাতিসংঘে ক্ষুদ্রতম সদস্য দেশ আয়তনে মোনাকো জন সংখ্যা টুভ্যালু ।
জাতিসংঘের মূল অঙ্গ সংস্থা
১। সাধারণ পরিষদ
২। নিরাপত্তা পরিষদ
৩। অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ
৪। সচিবালয়
৫। আন্তর্জাতিক আদালত
৬। অছি পরিষদ
সাধারণ পরিষদ
১৯৪৬ সালের ১০ জানুয়ারি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রথম অধিবেশন লন্ডনে ওয়েস্ট মিনিস্টার হলে অনুষ্ঠিত হয়।জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সাধারণত প্রতিবছর একবার অধিবেশন বসে।
প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে তৃতীয় মঙ্গল বার এ পরিষদের বাৎসরিক নিয়মিত অধিবেশন শুরু হয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন প্রতিটি সদস্য দেশ সর্বোচ্চ ৫জন প্রতিনিধি পাঠাতে পারে।
তবে সাধারণ পরিষদের প্রত্যেক রাষ্ট্রের একটি মাত্র ভোট দানের অধিকার রয়েছে। প্রত্যেক অধিবেশনের গুরুতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের ভোট পরিষদের একজন সভাপতি এক এক বছরের জন্য নির্বাচিত হন।
জাতিসংঘ সনদের নিয়ম-কানুন মেনে চলাচল বিশ্বের যে কোন শান্তি কামিনী দেশ জাতিসংঘের সদস্য হতে পারে। জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্র সাধারণ পরিষদের সদস্য। নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন সাপেক্ষে সাধারণ পরিষদ নতুন সদস্য গ্রহন করতে পারে।
মহাসচিব নিয়োগ নতুন সদস্য গ্রহন কোন সদস্য রাষ্ট্রকে বহিস্কার জাতিসংঘের বাজেট পাস সদস্য রাষ্ট্রের চাঁদার পরিমাণ নির্ধারণ বিভিন্ন সংস্থার সদস্য নির্বাচন নিরাপত্তা পরিষদের ওয়েবসাইট সদস্য নির্বাচন সংস্থার বার্ষিক রিপোর্ট পর্যালোচনা প্রবৃত্তি গুরুত্বপূর্ণ কাজে পরিষদ সম্পাদন করে।
প্রস্তাব গৃহীত হয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি বছর ২১ মার্চ আন্তর্জাতিক বর্ণ বৈষম্যবাদ বিরোধী দিবস পালন করা হয়।