পৃথিবীর প্রথম জাদুঘর স্থাপিত হয়েছিল কোথায়?

আলেকজান্দ্রিয়ায় নাকি পৃথিবীর প্রথম জাদুঘর স্থাপিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে বা তার কাছাকাছি সময়ে ঠিক নির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না। আমি তখন উপস্থিত ছিলাম না কিন্তু এটুকু দ্বিধাহীনভাবে বলা যায় যে সে সময়ে জাদুঘরতত্ত্ববিদদের কেউ তার ঘাড়ে কাছে ছিলেন না ।

কি প্রেরণা থেকে বিশেষজ্ঞ না হয়েও একজন মানুষ এমন একটা কাজ করেছিলেন এবং দর্শনার্থীরাই  বা সেখানে কোন প্রত্যাশা নিয়ে যেতেন তা আজ ভাববার বিষয়। পৃথিবীর এই প্রথম জাদুঘরে ছিল নিদর্শন সংগ্রহশালা ও গ্রন্থাগার ছিল উদ্ভিদউদ্যান ও উন্মক্ত চিড়িয়াখানা, তবে এটা নাকি ছিল মুখ্যত দর্শন চর্চার কেন্দ্র।

এর থেকে আমাদের মনে দুটি ধারণা জন্মে জাদুকর গড়ে উঠেছিল প্রতিষ্ঠাতার  রুচিমাফিক আর তার দর্শকেরা সেখানে যেতেন নিজের নিজের অভিপ্রায় অনুযায়ী বিশেষ বিশেষ অংশে হয়তো কেউ কেউ ঘুরে ফিরে সর্বক্ষেত্রেই উপস্থিত হতেন । কালক্রমে প্রাচীন জিনিসপত্র সম্পর্কে আগ্রহ বাড়ছিল এবং সম্পন্ন ব্যক্তি বা পরিবারের উদযোগে তা  তা সংগৃহীত হয়ে জাদুঘর গড়ার  ভিত্তি রচনা করছিল ।

প্রাচ্যদেশে ও এমন সংগ্রহের কথা অভিদিতে ছিল না তবে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের পরে পাশ্চাত্যদেশে এ ধরনের  প্রয়াস অনেক বৃদ্ধি পায় । এরকম ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জাদুঘরে কখনো কখনো জনসাধারণ সামান্য প্রজেক্ট মূল্য দিয়ে ঢুকতে পারত বটে তবে

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা সকলের জন্য খোলা থাকতো না।রাজ  রাজড়ারা বা সামন্ত প্রভুরা যেসব সংগ্রহশালা গড়ে তুলতেন, তাতে থাকতো ওইসব মহাশয়ের শক্তি সম্পদ ও গৌরবের ঘোষণা। ষোল শতকের আগে যৌথ কিংবা নাগরিক সংস্থার উদযোগে জাদুঘর নির্মাণের চেষ্টা হয়নি।

নবনির্মিত এসব জাদুঘরই জনসাধারণের জন্য  অবারিত হয় গণতন্ত্রের বিকাশের ফলে কিংবা বিপ্লবের সাফল্য। ফরাসি বিপ্লবের পরে প্রজাতন্ত্রই সৃষ্টি করে  লুভ উন্মোচিত হয় ভের্সাই প্রাসাদের দ্বার।রুশ বিপ্লবের পরে লেনিনগ্রাদের রাজপ্রসাদের গড়ে ওঠে হার্মিতিয়ে।টাওয়ার অফ লন্ডনের  মতো ঐতিহাসিক প্রাসাদ এবং তার সংগ্রহ সর্বজনের চক্ষুগ্রাহ্য হলো ।

তা বিপ্লবের না হলেও ক্রমবর্ধমান গণতন্ত্রায়ণের ফলে । ব্যক্তিগত সংগ্রহের অধিকারীরাও এক সময়ে তা জনসাধারণের কাছে উন্মুক্ত করার প্রেরণা বোধ করেন এবং কখনো কখনো এসব ব্যক্তিগত সংগ্রহের দায়িত্বভার রাষ্ট্র গ্রহণ করে তা সকলের গোচরীভূত করার ব্যবস্থা করে । 

১৭ শতকে  ব্রিটেনের প্রথম পাবলিক মিউজিয়াম গড়ে ওঠে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এখানকার অ্যাশমেলিয়াম মিউজিয়ামের সৃষ্টি হয় পিতাপুত্র দুই ট্র্যাডেসাণ্ট এবং অ্যাশমোল এই তিনজনের সংগ্রহ দিয়ে। ১৮ শতকে রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ মিউজিয়ম, তবে তার  ছিল অপর তিনজনের সংগ্রহ  স্যার হ্যানস স্লোন স্যার রবার্ট কটন ও আর্ল অফ অক্সফোর্ড রবার্ট হার্লির ।

এসব কথা উল্লেখ করার একমাত্র কারণ এই যে সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এবং তার পরিবর্তন যে জাদুঘরের রূপকে  বড় রকম প্রভাবাস্বিত করে সে বিষয়টা তুলে ধরা। জাদুঘরে ও  প্রবেশাধিকার না পেলে কিংবা নাগরিকদের জন্য জাদুঘর গড়ে না উঠলে সেখানে যাওয়ার প্রশ্নই উত্তর না, কেন যাব সে চিন্তা তো অনেক দূরের বিষয় ।

এই প্রসঙ্গে আরও একটা কথা বলা যেতে পারে পুজি বাদের সমৃদ্ধি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশের ফলে ১৯ শতকে জাদুঘরের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ওতাদের উপনিবেশে জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করতে থাকে ।

তেমনি একদিকে শিল্পোন্নতি এবং অন্যদিকে উপনিবেশবাদের অবসানের ফলে ২০ শতকে জাদুঘর স্থাপনার কাজটি দ্রুত এগিয়ে যায়, সদ্য স্বাধীন দেশগুলো ওআত্মপরিচয়দানের প্রেরণায় নতুন নতুন জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় প্রবৃত্ত হয়।

এই প্রসঙ্গে আমাদের আবার ফিরে আসতে হবে, তার আগে আর দুটি কথা বলি ।  একালে আলেকজান্দিয়ার মতো মেলানো মেশানো জাদুঘরের সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত বোধ হয় ব্রিটিশ মিউজিয়ম। সেখানে বৃহৎ গ্রত্নতান্ত্রিক ও ঐতিহাসিক সংগ্রহশালার সঙ্গে রয়েছে বিশাল গ্রন্থাগার; স্বতন্ত্রভাবে রয়েছে উদ্ভিদবিজ্ঞান ও  জীববিদ্যার জাদুঘর; রয়েছে নানা বিষয়ে অস্থায়ী প্রদর্শনী ও বক্তৃতার ব্যবস্থা ।

আর এসবের জন্য প্রয়োজন হয়েছে প্রাসাদোপম অট্টালিকার । অভ্যাগতদেরমধ্যে জিনিস যেখানে যেতে চান, যা দেখতে চান ও জানতে  জান, তিনি তা করতে পারেন। তবে এখানকার প্রবণতা হচ্ছে প্রাকৃতিক জগতে নিদর্শনের থেকে মানবসৃষ্ট নিদর্শন আলাদা করে রাখ, আর বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র নিয়ে ছোট বড় জাদুঘর গড়ে তোলা ।

গত ৩০ বছরে  ব্রিটেনের জাদুঘরের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে যদিও ব্রিটিশ মিউজিয়ামের সমতুল্য  দ্বিতীয় কোনো জাদুঘর  সে দেশের তৈরি হয়নি । জাদুঘরের বৈচিত্র্য আজ খুবই চোখে পড়ে। সে বৈচিত্র্য একদিকে যেমন সংগ্রহের বিষয়গত তেমনি গঠনগত এবং অন্যদিকে প্রশাসনগত।

আজ ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের জাদুঘর গোড়ের তোলার চেষ্টায় প্রবল  প্রত্যতন্ত ও ইতিহাস মানববিকাশ ও নৃত্যন্ত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি স্থানীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি সামরিক ইতিহাস পরিবহন ব্যবস্থা বিমান যাত্রা মহাকাশ ভ্রমণ পরিবেশ কৃষি উদ্ভিদবিজ্ঞান  জীবতত্ত্ব শিল্পকলা তার ও আবার নানান বিভাগ উপবিভাগ ।

কোনো  ব্যক্তিরবিশেষের জীবন ও সাধনা সম্পর্কিত জাদুঘর বহু দেশে বহু কাল ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আসছে। মৎ স্যাধার ও নক্ষত্রশালাও এখন জাদুঘর বলে বিবেচিত। জাদুঘর বলতে আজ আর ব্রিটিশ মিউজিয়াম আর  হার্মিতিয়ের  মতো বিশাল প্রাসাদ বোঝায় না । উন্মুক্ত জাদুঘর জিনিসটা এখন খুবই প্রচলিত ।

এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ভবনের একাংশে অবস্থিত হলেও জাদুঘরের গুরুত্ব হ্রাস পায় না। প্রশাসনের দিক দিয়ে স্বতন্ত্র শ্রেণীর জাদুঘরের মধ্যে রয়েছে জাতীয় জাদুঘর, স্থানীয় বা আঞ্চলিক জাদুঘর বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর ও একান্ত বা ব্যক্তিগত উদযগে গড়া জাদুঘর।

আমাদের দেশ থেকে উদাহরণ নিলে বলবো এখানে যেমন আছে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর তেমনি আছে চট্টগ্রামের  জাতিতান্ত্রিক জাদুঘর ঢাকার নগর জাদুঘর বঙ্গবন্ধু জাদুঘর বিজ্ঞান জাদুঘর ও সামরিক জাদুঘর রাজশাহীর বরেন্দ্র মিউজিয়াম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর ঢাকার  বলধাঁ গার্ডেন এবং বিভিন্ন প্রন্ততান্ত্রিক খননের এলাকায় সাইট মিউজিয়াম।

একজন কি দেখতে চান তা স্থির করে কোথায় যাবেন তা ঠিক করতে পারেন । তবে জাদুরের একটা সাধারণ লক্ষণ হচ্ছে যা চমকপ্রদ যা অন্য যা লুপ্তপ্রায় যা বিস্ময় উদ্রেককারী এমন সব বস্তু সংগ্রহ করা । গড়পরতা মানুষ তা দেখতে যায় দেখে  আপুত হয় ।

এই প্রসঙ্গে আমার একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। ঢাকায় আমাদের জাতীয় জাদুঘরের প্রথম ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আব্দুল মোনায়েম খান। অনেক আমন্ত্রিতদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিত্যন্ত্র কনিষ্ঠ শিক্ষক আমিও ছিলাম। লক্ষ্য করলাম শিক্ষামন্ত্রী তার ভাষণ পড়তে গিয়ে মুদ্রিত জাদুঘর শব্দের জায়গায় সর্বত্র মিউজিয়াম করছেন ।

চা খাওয়ার সময়ে আমাদের শিক্ষক প্রতীক অর্থমন্ত্রীর ড, এম এন হুদা আমাকে ডাকলেন। কাছে যেতে বললেন গভর্নর সাহেবের একটা প্রশ্ন আছে উত্তর দাও। গভর্নর জিজ্ঞাসা করলেন মিউজিয়মকে আপনারা জাদুঘর বলেন কেন? একটু হকচকিয়ে গিয়ে বললাম

স্যার জাদুঘরই মিউজিয়মের বাংলা প্রতিশব্দ।গভর্নর এবার  রাগতত্ত্বরে বললেন মিউজিয়মের যে আল্লাহর কালাম রাখা আছে তা কি জাদু? আল্লাহর কালাম বলতে তার মনে বোধ হয় ছিল, চমৎকার  তুঘরা হরফে লেখা নুসরাত শাহের আশরাফপুর শিলালিমি ষোল শতকে এক মসজিদ প্রতিষ্ঠার বৃত্তান্ত সংবলিত প্রস্তর খন্ড সেটা রাখা হয়েছিল সকলের চোখে পড়ার মতো জায়গায় ।

যাহোক গভর্নরের প্রশ্নের জবাবে আমি বললাম স্যার ওই অর্থ জাদু নয় বিস্বয় জাগায় বলে জাদু মা যেমন সন্তানকে বলে ওরে আমার জাদু রে। ব্যাখ্যার পরের অংশটা যথার্থ কিনা সে বিষয়ে এখন সন্দেহ হয়, তবে আবার বাক্য শেষ করার আগেই গভর্নর হুংকার দিলেন না জাদুঘর বলা চলবে না মিলিয়ম বলতে হবে ।

বাংলাও আপনারা মিউজিয়ামই বলবেন। তর্ক করা বৃথা হুকুম শিরোধার্য করে আমার চ্যান্সলরের সামনে থেকে পালিয়ে এলাম।যঃ পলায়েতে স জীবতি । আরো একটা প্রবাদ আছে চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। আমারও তাই হলো। গভর্নরের সামনে থেকে চলে আসার পর মনে হলো তাকে বললাম না কেন জাদু শব্দটা ফারসি তাতে হয়ত তিনি কিছুটা স্বস্তি পেলেন ।

আপনারা অনেকেই জানেন জাদুঘর পুরোটাই পারসি তবে জাদুঘরের ঘরটা বাংলা। উর্দুতে জাদুঘরকে বলে আজবখানা হিন্দিতে অজয়ের ঘর। খানা ফারসি আজব আজিব আজায়েব আরবি। জাদু ও আজব শব্দে দ্যোতনাআছে দুরকম একদিকে কুহক ইন্দ্রজাল ভেলকি অন্যদিকে চমৎকার মনোহর  কৌতুহলোদ্দীপক ।

আমার ছেলেকে সোজা পেয়ে মেয়েটা জাদু করেছে আর কি জাদু বাংলা গানে দু’রকম দ্যোতনা প্রকাশ করে । বয়সের দোষে এক কথা থেকে অন্য কথায় চলে যাচ্ছি । মোনায়েম খান যে সেদিন রাগ করেছিলেন এবং জাদুঘরের অন্য অনেক কিছু থাকা সত্ত্বেও যে তিনি আল্লাহর কালামের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য করেছিলেন, এখন মনে হয় আর একটা তাৎপর্য ছিল ।

তিনি দ্বিজাতিত্বের বিশ্বাসী ছিলেন, তাই জাদুঘরে সংরক্ষিত মুসলিম ঐতিহ্য মূলক নিদর্শন তাকে আকর্ষণ করেছিল এবং বাংলায় হিন্দু মুসল মান নির্বিশেষে জাদুঘরকে যেহেতু জাদুঘর বলে তাই তিনি সেটা বর্জন করে মিউজিয়াম শব্দটি বাংলায় ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন মুসলমান দের স্বতন্ত্র প্রয়োগ হিসেবে । জাদুঘরকে যদি তিনি আত্মপরিচয় লাভের ক্ষেত্র থাকেন তাহলে মোটেই  ভুল করেননি ।

অল্প বয়সে আমি যখন প্রথম ঢাকা জাদুঘরে যাই তখন আমিও এক ধরনের আত্ম পরিচয়ের সূত্র সেখানে খুঁজে পাই কতটা সচেতন ভাবে না  হলেও। বাংলা স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের প্রাচীন নিদর্শনের সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয় ঘটে।  স্থাপত্যের নিদর্শন বলতে প্রধানত ছিল কাঠেরও পাথরের স্তম্ব আর ভাস্কর্য ছিল অজস্র ও নানা উপকরণে তৈরি ।

বঙ্গদেশে অত্র যে বৌদ্ধ মুক্তি আছে সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না;   পৌরাণিক লোকিক অত্র যে দেব-দেবী আছে তাও জানতাম না। মুদ্রা এবং  অস্ত্রশস্ত্র দেখে বাংলায় মুসলিম শাসন সম্পর্কে কিছু ধারনা হয়েছিল ইশা খার কামানের গায়ে বাংলা লেখা দেখে মুগ্ধ হয়ে ছিলাম । পোরা মাটির কাজও ছিল কত বিচিত্র ও সুন্দর ।

জাদুঘরের বাইরে তখন রক্ষিত ছিল নীল জাল দেওয়ার মস্ত বড় কড়াই। নীল আন্দোলনের ইতিহাস কিছুটা জানতাম। কড়াইয়ের বিশালত্ব চিত্রে সম্ভম জাগাবার মতো কিন্তু তার সঙ্গে যে অনেক দীর্ঘ শ্বাস ও অশ্রু বিন্দু জড়িত সেটা মনে পড়তে ভুল হয়নি।

ঢাকা জাদুঘরে যা দেখেছিলাম তার কথা বলতে গেলে পরে দেখা নিদর্শনের সঙ্গে জড়িয়ে যেতে পারে কিন্তু বঙ্গের হাজার বছরের পুরনো ইতিহাস ও সমৃদ্ধ ও সংস্কৃতির যে নমুনা সেখানে ছিল তা থেকে আমি বাঙালি আত্মপরিচয় লাভ করেছি। পরে তা শক্তিশালী হয়েছে কলকাতা জাদুঘর ও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল  দেখে।

পরবর্তীকালে পৃথিবীর বহু জাদুঘরে আত্মপরিচয়জ্ঞাপনের  এই চেষ্টা নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধরে রাখার  যত্নকৃত প্রয়াস দেখেছি ।   আলেকজান্দিয়ার গ্রেকো রোমান মিউজিয়ামে ও কয়রো মিউজিয়মে  যেমন মিশরের পুরনো ইতিহাস ধরে রাখা হয়েছে  সিয়াটলে ও  নর্থ  ক্যারোলোইনার পূর্ব প্রান্তে দেখেছি আমেরিকার আদিবাসীদের নানাবিধ অর্জনের নিদর্শন ।

এবং ইউরোপীয়  বসতিস্থাপনাকারীদের প্রথম আগমনকালীনস্মৃতি স্মৃতিচিহ্ন। ব্রিটিশ মিউজিয়ম এবং টাওয়ার অফ লন্ডনে ইংল্যান্ডে ইতিহাসের অনেকখানি ধরা আছে। কুয়েতের জাদুঘরে আমার ছেলেবেলায় দেখা ব্রিটিশ ভারতীয় মুদ্রার সযন্ত স্থান দেখে চমৎকৃত হয়েছি বুঝেছি তাদের আত্মনুসন্ধান শুরু হয়েছে কিন্তু দূর ইতিহাসের পাথুরে প্রমাণ হাতে আসেনি।

এতে কোন সন্দেহ নেই যে জাদুঘরের একটা প্রধান কাজ হল সাংস্কৃতির ঐতিহ্যর সংরক্ষণ এবং জাতিকে আত্মপরিচয়দানের সূত্র জানানো  ।জাদুঘরে আমাদের যাওয়ার এটা একটা কারণ । সে আত্মপরিচয়লাভ  অনেক সময়ে সামাজিক রাজনীতি বা রাষ্টিক পরিবর্তনেরও সূচনা করে ।

 টাওয়ার অফ লন্ডনে সকলে ভিড় করে কোহিনূর দেখতে । আমিও তা দেখতে গিয়েছিলাম। তখন আমার আরেকটা কথা মনে হয়েছিল । জাদুঘর  সংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের জায়গা বটে তবে তা সবসময় নিজের জিনিস হবে, এমন কথা নেই। অন্যর ঐতিহ্যকর উত্তরাধিকার হরণ করে এনেও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নিজেদের জাদুঘর সাজাতে কুন্ঠিত বোধ করে না। 

তবে একটা কথা স্বীকার করতেই হবে। ব্রিটিশ মিউজিয়মে নানা দেশের নানা নিদর্শন সংহিত হয়েছে। কী উপায়ে  সংহিত হয়েছে সে কথা আপাতত  মুলতবি রাখলাম। কিন্তু এসব দেখে অভিন্ন মানব সত্তার সন্ধান পাওয়া যায়। মনে হয় এত দেশে এত কালো মানুষ যা কিছু করেছে তার  সবকিছুর মধ্যে আমি আছি।

 জাতীয় জাদুঘর একটা জাতিসত্তার পরিচয় বহন করে। যে সেখানে যায় সে তার নিজের ও জাতির স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে, সাংস্কৃতির সন্ধান পায, আত্মবিকাশের প্রেরণ লাভ করে। এই যে শত সহস্র বছর আগের সব জিনিস যা হয়ত একদিন ব্যক্তির বা পরিবারের  কুক্ষিগত ছিল তাকে যে নিজের বলে ভাবতে পারি তা কি কম কথা? আবার অন্য জাতির অনুরূপ কীর্তির সঙ্গে যখন আমি একাত্মতা অনুভব করি তখন আমার উত্তরণ হয়  বৃহত্তর মানব সমাজে।

জাদুঘর আমাদের জ্ঞান দান করে আমাদের শক্তি যোগায় আমাদের চেতনা জাগ্রত করে আমাদের মনোজগতকে সমৃদ্ধ করে। জাদুঘর একটা শক্তিশালী সামাজিক সংগঠন। সমাজে এক স্তরে সঞ্চিত জ্ঞান তা ছড়িয়ে দেয় জনসমাজের সাধারণ স্তরে। গণতন্ত্রায়ণের  পথ ও  প্রশস্ত হয় এভাবে। জাদুঘর শুধু জ্ঞানই ছড়িয়ে দেয় না অলক্ষ্যে ছড়িয়ে দেয় ভাবাদর্শ।

কাজেই এ কথা বলা যেতে পারে যে জাদুঘর যেমন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ভাবনার সৃষ্টি তেমনি তা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনেরও কারণ ঘটাতে পারে । আরও একটা সোজা ব্যাপার আছে। জাদুঘর আমাদের আনন্দ দেয়।

মানুষের অনন্ত উদ্ভাবননৈপুণ্য তার নিরলস সৃষ্টিক্ষমতা তার  তন্নিষ্ঠ সৌন্দর্য সাধনা তার নিজেকে বারংবার অতিক্রম করার প্রয়াস এসবের সঙ্গে পরিচয় হয়ে আমরা অশেষ  উল্লাসিত হই।  এত কিছুর পরেও যদি কেউ প্রশ্ন করেন জাদুঘরে কেন যাবে সূক্ষ্ম কুতুব সঞ্চার করে প্রাবন্ধিক  পরিশেষে লিখেছেন যে তাহলে তার একমাত্র উত্তর বোধ হয় এই কে বলছে আপনাকে যেতে?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *