কাজী নজরুল ইসলামকে “বিদ্রোহী কবি” উপাধি দেন প্রমথ চৌধুরী। ১৯২২ সালের ২২ অক্টোবর, ধূমকেতু পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত “বিদ্রোহী” কবিতাটি প্রকাশের পর প্রমথ চৌধুরী এই উপাধি দেন।
“বিদ্রোহী” কবিতাটিতে নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় প্রতিবাদ করেন। তিনি সমাজের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ করেন। এই কবিতাটি প্রকাশের পর সমগ্র ভারতে নজরুল ইসলামের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এবং তখন থেকেই তিনি “বিদ্রোহী কবি” হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন।
প্রমথ চৌধুরী “বিদ্রোহী” কবিতার ভূমিকায় লিখেছিলেন, “এই কবি অসাধারণ। তার কবিতার মধ্যে একটি নতুন যুগের ধ্বনি, একটি নতুন আশার আলো। তার কবিতায় একদিকে আছে তীব্র বিদ্রোহ, অন্যদিকে আছে উদার প্রেমের উচ্ছ্বাস।” প্রমথ চৌধুরীর এই উপাধি নজরুল ইসলামের কবিতার প্রকৃত প্রকৃতিকে সঠিকভাবে তুলে ধরে।
কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯–১৯৭৬) কাজী নজরুল ইসলাম 1999 সালের ২৪ শে মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তার ডাকনাম ছিল দুখু মিয়া । সাহিত্যে সব শাখার অবদান থাকলেও তিনি মূলত কবি হিসেবে পরি চিত। এবংকাজী নজরুল ইসলামকে বিদ্রোহী কবি উপাধি দেন বরীন্দ্রকুমার ঘোষ।
পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ ,মাতার নামঃ জাহেদা খাতুন ।
১। তাঁর পিতা ছিলেন এক মাজারের খাদেম ও ওই মাজারের নিয়ন্ত্রণাধীন মসজিদের ইমাম।
২। মাত্র আট বছর বয়সে মৃত্যু (১৯০৭) হলে চরম দারিদ্র্য দূর পতিত হন।
৩। ১০ বছর বয়সে গ্রামের মক্তব থেকে নিম্ন প্রাইমারি পরীক্ষায় পাশ করে এখানেই এক বছর শিক্ষকতা করেন।
৪। গ্রামের কয়েকজন মাতব্বর তাকে রানীগঞ্জের কাছে পিয়ারসন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন । স্কুল থেকে পালিয়ে আসানসোলে এক রুটির দোকানে কাজ নেন।
কাজিন ফকির উদ্দিন নামে সেখানকার এক দারোগা তার গান শুনে নিজ বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুল সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে দেন।
৫। ১৯ ১৪-রডিসেম্বরে এখান থেকে পালিয়ে ফের সিয়ারসোল স্কুল অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন । ভালো ছাত্র হওয়ার স্কুলের বেতন মাপক বিনামূল্যে বোর্ডিংয়ের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়।
৬। এরপূর্বে অল্প সময়ের জন্য একটি নাটক বাংলার আর অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিত্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমান নাট্যদল দলে যোগ দেন। তার চাচা কাজী ফজলে করিম লেটো ওস্তাদ ছিলেন।
ধারণা করা হয় তার এভাবে কাজী নজরুলের যোগদেন। কৈশোরে বিভিন্ন থিয়েটারে কাজ করার সুবাদে কবিতা, নাটক ও সাহিত্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন ।
৭। বাংলা ভাষার তিনি প্রথম ইসলামী গান ও গজল রচনা করেন। এছাড়াও তিনি অনেক অতিষ্ঠ শ্যামা সংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতি রচনা করেন। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা প্রায় ৩,০০০ এবং অধিকাংশ তিনি নিজের সুরারোপ করেছেন। এখন এগুলো নজরুল সংগীত নজরুল গীতি নামে পরিচিত ।
৮। বাংলা সাহিত্যে মুক্তক ছন্দের প্রবর্তক।
৯। মধ্যবয়সে তিনি ১৯৪২ সালে পিক্র ডিজজে আক্রান্ত হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললে সাহিত্যকর্ম থেকে দূরে থাকতে হয় বোধশক্তি হারানো ১৯৪৩ সালে।
১০। ২৯ শে আগস্ট ১৯৭৬ (১৩৮৩বঙ্গাব্দ ১২ ভাদ্র) সকালে ১০ টা ১০ মিনিটে ঢাকার পিজি হাস পাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তাকে পরিপূর্ণ সামরিক মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।
নজরুলের দাম্পত্য জীবন
কুমিল্লা দৌলতপুরে থাকাকালে আলী আকবর খানের বোনের মেয়ে সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিসের সাথে কোভিদ সখ হয়। ১৯২১সালের 18 জুন নজরুল নার্গিসের বিবাহ সম্পন্ন হয়।
কিন্তু কাবিনের শর্তে আলী আকবর খান নজরুলকে ঘরজামাই থাকা শর্ত জুড়ে দেন যা নজরুল কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। ফলে বাসর রাতে দৌলতপুর ছেড়ে চলে যান।
এর 16 দুলদুল নার্গিস কোনো যোগাযোগ হয়নি । ১৯৩৭ সালে নার্গিস-নজরুল কে একটি চিঠি লিখেন।
১৯২৪ সালের 25 এপ্রিল নুরজুল কুমিল্লা কান্দিরপাড় এলাকার মেয়ে আশালতা সেনগুপ্তা যুলি ওরফে প্রমীলা দেবীকে বিয়ে করেন। প্রমীলাকে নিয়েই কেটেছিল নজরুলের দাম্পত্য জীবন।
সাহিত্যকর্ম
বাউল এর আত্মকাহিনীঃনজরুলের প্রথম রচনা। ১৯১৯ সালে সওগাত পত্রিকার মে-জুন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
কবিতা শ্রাবণ ১৩২৬ বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকাঃ
গল্পগ্রন্থ – ব্যথার দান ফেব্রুয়ারি (১৯২২)
কাব্যগ্রন্থ – অগ্নিবীণা সেপ্টেম্বর( ১৯২২)
উপন্যাস — বাঁধনহারা ( ১৯২৭)
প্রবন্ধ — তুর্ক মহিলা ঘোমটা খোলা কার্তিক ৩২৬ সওগাত পত্রিকা
প্রবন্ধ গ্রন্থ — যোগবাণী অক্টোবর (১৯২২)
নাটক — ঝিলিমিলি (১৩৩৪)
বাজেয়াপ্ত গ্রন্থ — বিষের বাঁশি
উপন্যাস
বাঁধনহারা (১৯২৭)
মৃত্যুক্ষুধা (১৯৩০)
কুহেলিকা (১৯৩১)
নজরুলের কাব্য সংখ্যা মোট ২২ টি। কাব্য (বিদ্রোহ প্রদান)
১। অগ্নিবীণা (১৯২২) প্রথম কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ ।
২। বিষের বাঁশি (১৯২৪)গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয় এ দেশের নারী অধিকার আন্দোলনের
৩। মনিকা মিসেস এম রহমানকে মোহাম্মদ মাসুদা খাতুন
৪। ভাঙ্গার গান ১৯২৪ মেদিনীপুরবাসির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়।
শীকর বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
সাম্যবাদী (১৯২৫)
সর্বহারা (১৯২৬) উৎসর্গ করা হয় বিরজাসুন্দরী দেবীকে।
ফণিমনসা (১৯২৭)
সঞ্চিতা (১৯২৮) বিভিন্ন কাব্যর বাছাইকৃত কবিতা সংকলন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করা হয়।
জিঞ্জির (১৯২৮)
সন্ধ্যা (১৯২৯) উৎসর্গ মাদারীপুর শান্তিসেনা।
প্রলয় শিখা (১৯৩০)
নির্ঝর (১৯৩৮)
নতুন চাঁদ (১৯৪৫)
ঝড় (১৯৬০)
গল্পগ্রন্থ
ব্যথার দান (১৯২৭)
রিক্তের বেদন
শিউলি মালা
পদ্মগোখরা
জিনের বাদশা
নাটক
ঝিলিমিলি (১৯৩০)
আলেয়া (১৯৩১)
পুতুলের বিয়ে (১৯৩৩)
মধুমালা (১৯৬০)
কাজী নজরুল বাংলাদেশের রণসঙ্গীতের রচয়িতা
বাংলাদেশ রণ সংগীত চল চল চল ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল নিম্নে উতলা ধরণী তল ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে যোগদানের জন্য নজরুল ঢাকায় আসেন।
তখন সৈয়দ আবুল হোসেনের সরকারি ভাষার বর্ধমান হাউস বর্তমান বাংলা একাডেমি অবস্থান কালে এই গানটি রচনা করেন।
গানটি প্রথমে নতুনের গান শিরোনামে শিখা পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পরে সন্ধ্যা কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের তৎকালীন মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে এই গানটিকে বাংলাদেশের রণ সংগীত হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।
বাংলাদেশের যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠানের এর ২১ লাইন যত্ন সংগীত বাজানো হয়।
নজরুলের কারাবরণ
তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা ধূমকেতু পত্রিকা,র ২২ সেপ্টেম্বর ১৯২২ সংখ্যায় আনন্দময়ীর আগমনের কবিতা প্রকাশের জন্য 23-11-19 22 তারিখে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়।
16 জানুয়ারি ১৯২৩ রাজদ্রোহের অভিযোগে এক বছরের কারাদণ্ড হয়। আলিপুর জেলে দীর্ঘদিন আটক রাখার পর তাকে হুগলি জেলে পাঠানো হয়। হুগলি জেলের বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে অনির্দিষ্টকালের জন্য অনশন করেন।
শেষ পর্যন্ত ফিরোজা সুন্দরীর অনুরোধে ৩৯ দিন পর ২২ মে ১৯২৩ লেবুর রস পান করে অনশন ভঙ্গ করেন। ১৯৩০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর প্রলয় শিখা কাব্যগ্রন্থ করেই সরকার থেমে থাকেনি।
মুদ্রণ ও প্রকাশনা আর অপরাধের নজরুলকে ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয় । কবি রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন এবং গান্ধী আরউন চুক্তির পর থেকে মুক্তি পান।