“সততার পুরস্কার” গল্পের লেখক হলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। এই গল্পটি ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা প্রথম পত্রের চারুপাঠ বইতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। গল্পটি একটি হাদিসের কাহিনি অবলম্বনে রচিত। গল্পে তিনজন ইহুদির সততার পরীক্ষার কথা বর্ণিত হয়েছে।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন একজন বিখ্যাত বাঙালি ভাষাবিদ, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে একজন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।
অনেক দিন আগে এক শহরে এক দর্জি বাস করতো । দর্জি প্রতিদিন দোকান খুলে খদ্দেরদের অর্ডার নিতো । একদিন তার দোকানে হাজির হলো এক কুঁজো । তার পিঠে বিরাট একটা কুঁজ । লোকটার চেহারা দেখলে না হেসে থাকা যায় না । কুঁজো দোকানে ঢুকে নানা ধরনের অঙ্গভঙ্গি করে নাচতে শুরু করলো ।
এমনিতেই কুঁজো , তার উপর অদ্ভুত নাচানাচি দেখে দোকানে লোকেরা হাসিতে লুটোপুটি খেতে লাগলো । দর্জি তখন পুজোকে তার বাসায় নিয়ে যাওয়ার মনস্ত করল । তার বৌকে কুঁজোর নাচ দেখাবে । রাতের বেলাটা খেয়েদেয়ে তার বাড়িতেই থাকতে পারবে । কুঁজো দর্জির প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল ।
দর্জি কুঁজোকে নিয়ে বাড়িতে এলো । কুঁজো আবার অঙ্গভঙ্গি সহ নাচ দেখাতে শুরু করলো । দর্জি আর তার বৌ হেসে খুন । সন্ধ্যা হলো । দর্জির বৌ খাবার পরিবেশন করলো ।
খাওয়ার আসরে বসেও কুঁজোর রঙ তামাশা সমানভাবে চললো । দর্জির বউ তখন বললো, ‘’আপনিতো অনেক খেলা দেখালেন । আচ্ছা এই মাছটা না চিবিয়ে পুরোটা গিলতে পারেন কিনা দেখি তো?’’
কুঁজো বললো, ওটা মোটেই কোনো কঠিন কাজ নয় । দিন, আস্ত গিলে খেয়ে ফেলবো । কিন্তু কুঁজোর সব ঝারিঝুরি এবার ভেস্তে গেল । মাছ গিলতে গিয়ে পুরো মাছটা তার গলায় আটকে গেল । দম গেল বন্ধ হয়ে । আর সাথে সাথে মাটিতে ধপাস করে পড়ে গেল ।
অনেক ডাকাডাকিতে ও যখন উঠলো না, তখন দর্জি ভাবলো কুঁজো বুঝি মারাই গেল । তার সর্বনাশ হয়ে গেল । বিনা দোষে তাকে মৃত্যুদণ্ড ভোগ করতে হবে ।
অনেক ভেবে চিন্তে দর্জি আর তার বৌ মিলে একটা বুদ্ধি বের করলো । দু’জনে ধরাধরি করে তাকে পাশে এক ডাক্তারের বাড়িতে নিয়ে গেল । ডাক্তার তখন মেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলো ।
বাড়ির কাজের মেয়ে দরজা খুলে দিলো । মেয়েটি ডাক্তারকে ডাকতে দোতলায় গেল । আর এই ফাঁকে দর্জি আর তার বৌ কুঁজোকে সিঁড়ির মাঝখানটায় বসিয়ে পালিয়ে গেল ।
ডাক্তার বেশ হ্রষ্টচিওেই রোগী দেখতে এলো । কিন্তু সিঁড়িটা ছিল অন্ধকারে ঢাকা । তাই সে কুঁজোকে দেখতে পায় নি । সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় কুঁজোর গায়ে হোঁচট খেয়ে দুজনেই হুমড়ি খেয়ে পড়লো ।
ডাক্তার রোগীর গায়ে হাত দিয়ে দেখে রোগী মরে গেছে । সর্বনাশ ,এখন উপায়? ডাক্তার তাড়াতাড়ি বৌয়ের সাথে পরামর্শ করলো । বৌয়ের আবার বুদ্ধিটা ছিল পাকা । সে চট করে একটা বুদ্ধি বের করে ফেললো ।
তাদের পাশের বাড়িতেই থাকে রাজবাড়ির খানসামা । রাতের বেলা তার বাড়ি ফিরতে দেরি হয় । দুজনে মিলে কুজোকে ধরে খানসামার বাড়ির দরজার সামনে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে এলো ।
খানসামার সেদিন রাতে দাওয়াত ছিল । খাওয়াদাওয়ার পরিমাণ একটু বেশি হয়ে গিয়েছিলো । তাই শরীরটা বেশ ভারী ভারী মনে হতে লাগলো । সে বাড়ির কাছে এসে দরজার সামনে কুঁজোকে দেখে ভাবলো, নিশ্চয় চুরি করতে এসেছে । পেছন থেকে গিয়ে মারলো বিরাশি শিক্কার এক কিল । ব্যস কুঁজো মাটিতে কুপোকাৎ হয়ে পড়ে গেল ।
হায় হায় কোটালের কানে কথাটা গেলে নির্ঘাৎ মৃত্যু । তাই করলো কি, কুঁজোকে কোলে তুলে রাস্তার পাশে একটা দোকানের কাছে বসিয়ে রেখে এলো । দেখলে বুঝবার উপায় নেই যে লোকটা মৃত । মনে হবে সে বসে বুঝি মুচকি মুচকি হাসছে ।
রাত গভীর হতে লাগলো । সেই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল এক পথচারী । কুঁজোকে রাস্তার উপর বসে মুচকি হাসতে দেখে পথচারী ভাবলো নিশ্চয় লোকটার কোন মদ মতলব আছে । সে কালবিলম্ব না করে কুঁজোকে আক্রমণ করলো । তার কিলঘুষি আর চিৎকারে লোকজনে ভিড় জমে গেল । তারা দেখলো পথচারী কুঁজোকে মেরে ফেলেছে ।
তখন তারা পথচারীকে মারতে শুরু করলো । এমন সময় সেখানে এক পাহারাদার এসে হাজির । পাহারাদার পথচারী আর কুঁজোকে নিয়ে গেল কোটালের ওখানে । কোটাল পথচারীকে কাজীর ওখানে পাঠিয়ে দিলো । রাত পোহালে তার বিচার হবে ।
সকাল হলো । কাজীর বিচারে পথচারী দোষী সাব্যস্ত হলো । কাজী তাকে শুলে চড়ানোর আদেশ দিলেন । কিন্তু পথচারীকে শূলে চড়াবার সময় সেখানে ছুটে এসে হাজির হলো খানসামা ।
সে নিজের দোষ স্বীকার করে কাজী সাহেবকে বললো ,কুঁজোর মৃত্যুর জন্য সে-ই দায়ী । সুতরাং তাকেই শুলে চড়ানোর আদেশ দেওয়ার জন্য কাজী সাহেবকে হাতজোড় করে অনুরোধ জানালো ।
কাজী খানসামার কথা শুনে ভীষণ রেগে গেলেন । সঙ্গে সঙ্গে তাকে শুলে ছড়াতে আদেশ দিলেন । কিন্তু তাঁর আদেশ পালন করার আগেই সেখানে হাজির হলো ডাক্তার । হাঁপাতে হাঁপাতে পুজোর মৃত্যুর কারণ সে ডাক্তার নিজে সেকথা বললো । সুতরাং নির্দোষ খানসামাকে খালাস দিয়ে সুলে চড়ানো হোক ।
স্বীকার করে কাজী সাহেবকে বললো ,কুঁজোর মৃত্যুর জন্য সে-ই দায়ী । সুতরাং তাকেই শুলে চড়ানোর আদেশ দেওয়ার জন্য কাজী সাহেবকে হাতজোড় করে অনুরোধ জানালো ।
কাজী খানসামার কথা শুনে ভীষণ রেগে গেলেন । সঙ্গে সঙ্গে তাকে শুলে ছড়াতে আদেশ দিলেন । কিন্তু তাঁর আদেশ পালন করার আগেই সেখানে হাজির হলো ডাক্তার ।
হাঁপাতে হাঁপাতে পুজোর মৃত্যুর কারণ সে ডাক্তার নিজে সেকথা বললো । সুতরাং নির্দোষ খানসামাকে খালাস দিয়ে সুলে চড়ানো হোক ।
ডাক্তারের সততা দেখে তো কাজী সাহেব দারুন বিস্তৃত! বলে কি লোকটা । কিন্তু আইনের চোখে সবাই সমান । সুতরাং কাজী সাহেবকেও আইন মতোই সাজা দিতে হবে । তিনি খানসামার বদলে ডাক্তারকে শুলে চরাতে হুকুম দিলেন ।
বিস্ময়ের পালা আরো আরো বাকি ছিল । ডাক্তারকে চুলের কাছে নিয়ে যেতে না যেতেই সেখানে হাজির হলো দর্জি । দু,হাত জোড় করে দর্জি কূঁজোর মৃত্যুর জন্য সেই যে দায়ী সে কথা সবিস্তারে বলল । সুতরাং কাউকে শুলে চরাতে হলে তাকে যেন শুলে চড়ানো হয় ।
রাজার কাছে সব খবর পৌঁছলো । তিনি কাজী সাহেব সহ সবাইকে তলব করে পাঠালেন । কুঁজোর দেহসহ সবাইকে তক্ষুনি রাজদরবারে হাজির করার নির্দেশ দিলেন ।
কাজী কুঁজোর লাশ আর অভিযুক্তদের নিয়ে হাজির হলেন রাজার দরবারে । রাজা তাদের মুখ থেকে ঘটনার বিবরণ শুনে তো বস্তুরমতো অবাক । এমন সৎ লোকও যে তার দেশে আছে সে কথা জেনে তার বুকটা ফুলে উঠলো । তিনি তাদের সততা ও সৎ সাহস দেখে মুগ্ধ হলেন ।
রাজদরবারে সকলের সাথে এক হাতুড়ে ডাক্তার ও হাজির হয়েছিল । সব কথা শুনে তার মনে কেমন যেন একটা খটকা লাগলো । তার কেন যেন মনে হলো লোকটা মরেনি । সে রাজার কাছে কুজোকে পরীক্ষা করে দেখার অনুমতি চাইলো ।
রাজা অনুমতি দিলেন । হাতড়ে ডাক্তার কুঁজোর বুকে কান পেতে পরীক্ষা করলো । হৃদপিন্ডের ধুপধুকানি একেবারে বন্ধ হয়ে যায় নি । কুঁজোর মুখটা হাঁ করিয়ে একটা চিমটে দিয়ে গলায় আটকানো মাছটা বের করে আনলো ।
তারপর কুঁজোর চোখ মুখে পানি ছিটিয়ে দিলো । আস্তে আস্তে কুঁজোর জ্ঞান ফিরে এলো । চোখ মেলে সে ফ্যাল ফ্যাল করে চারদিকে তাকানো । তাকে চোখ খুলতে দেখেতো সবাই অবাক । আরে লোকটা যে মরেনি বেঁচে আছে । আসলে হয়েছিলো কি, মাছটা গলায় আটকে গিয়ে পুজোর দম প্রায় বন্ধ হয়েছিলো ।
মাছটা বের করে দিতেই অবার দম ফিরে পেলো । রাজা ও কাণ্ডকারখানা দেখে বিস্ময়ে হতবাক । তিনি কুঁজো আর হাতুড়ে ডাক্তারকে প্রচুর পুরস্কার দিলেন । অভিযুক্তদেরও প্রচুর পুরস্কার দিয়ে ছেড়ে দিলেন । শুধু তাই নয়, তিনি হাতুড়ে ডাক্তার আর কুঁজোকে রাজদরবারে চাকরিতে বহাল করে দিলেন ।
তখন থেকে কুঁজো রাজদরবারে অঙ্গভঙ্গি করে নানা রকম রঙ তামাশা দেখিয়ে দরবারের সবাইকে আনন্দ দান করতো ।