বাহাদুর শাহ জাফরের বংশধরদের ভরণ-পোষণ কেন করত ব্রিটিশ সরকার?

ভারতবর্ষের ইতিহাসে মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে ওঠেন। কিন্তু বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পর, তার রাজত্বের সমাপ্তি ঘটে এবং তিনি ব্রিটিশদের হাতে বন্দী হন। এরপর থেকে তার বংশধরদের ভাগ্যে ঘটে যায় চরম দুর্দশা। তবে, একটি প্রশ্ন এখনও মানুষের মনে উদয় হয়—কেন ব্রিটিশ সরকার বাহাদুর শাহ জাফরের বংশধরদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিয়েছিল?

বাহাদুর শাহ জাফরের পরিবারের কি হয়েছিল?

বাহাদুর শাহ জাফর ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট, যিনি ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় দিল্লির সিংহাসনে ছিলেন। বিদ্রোহের পর, ব্রিটিশ বাহিনী বাহাদুর শাহ জাফরকে পরাজিত করে এবং তাকে বন্দী করে। তার পরিবারের সদস্যদেরও নানা দুর্দশার মুখোমুখি হতে হয়েছিল।

বাহাদুর শাহ জাফর: তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১৮৫৮ সালে তাকে Rangoon (বর্তমান ইয়াংগুন) বর্মায় নির্বাসিত করা হয়, যেখানে তিনি ৭ বছর বেঁচে থাকেন এবং ১৮৬२ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তার স্ত্রী, জিনাত মাকানি: তিনি তার স্বামীর সঙ্গে নির্বাসিত হন এবং বর্মায় একটি কষ্টকর জীবন কাটান। তিনি তার স্বামীর মৃত্যুর পর কিছু সময় বাঁচেন, তবে তার পরিণতি খুবই দুঃখজনক ছিল।

 

তার পুত্র, মির্জা মুঝফর: বাহাদুর শাহ জাফরের এক ছেলে ছিলেন, যাকে ব্রিটিশরা বন্দী করে। পরবর্তীতে, মির্জা মুঝফরকে ব্রিটিশদের হুকুমে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তার অন্য সন্তানরা: বাহাদুর শাহ জাফরের অন্যান্য সন্তানেরাও সিপাহী বিদ্রোহের পর বন্দী হয় এবং তাদের জীবন কষ্টে ভরা ছিল। অনেককেই বিদেশে নির্বাসিত করা হয়, এবং তারা সাধারণত দরিদ্র অবস্থায় জীবন কাটায়।

 

ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য

১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর মুঘল সাম্রাজ্যের প্রভাব পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায়। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে তাদের শাসন সুসংহত করার জন্য বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন করেছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল বিদ্রোহ দমন এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে শাসনের প্রতি ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর, বাহাদুর শাহ জাফরকে বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) রেঙ্গুনে নির্বাসিত করা হয়।

 

ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পেরেছিল, মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতীক হিসেবে জাফরের বংশধররা জনগণের মধ্যে বিপ্লবের অনুপ্রেরণা হতে পারে। তাই তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই কারণে ব্রিটিশ সরকার তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এর পেছনে ছিল মূলত তিনটি উদ্দেশ্য প্রতীকী প্রভাব কমানো মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতীক হিসেবে বাহাদুর শাহ জাফরের বংশধরদের জীবনযাত্রাকে সীমিত করে রাখা হয়েছিল।

 

তাদের জীবনে রাজকীয় মর্যাদা ফিরিয়ে না দিয়ে, ব্রিটিশরা তাদের অস্তিত্বকে জনগণের কাছে তুচ্ছ করে তুলতে চেয়েছিল। বিদ্রোহের সম্ভাবনা হ্রাস: ব্রিটিশরা জানত, যদি বংশধরদের আর্থিকভাবে সম্পূর্ণভাবে অবহেলা করা হয়, তবে তারা জনগণের সহানুভূতি এবং সমর্থন পেতে পারে। তাই নিয়ন্ত্রিত ভরণ-পোষণের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতাহীন রাখা হয়। নৈতিক দায়িত্ব: যদিও ব্রিটিশরা বাহাদুর শাহ জাফরকে বন্দী করেছিল এবং তার রাজত্ব কেড়ে নিয়েছিল, তবুও তাদের শাসনব্যবস্থার বৈধতা বজায় রাখতে তারা মুঘল পরিবারের প্রতি কিছুটা মানবিক দায়িত্ব পালন করে।

 

বাস্তব পরিস্থিতি

ব্রিটিশরা মুঘল বংশধরদের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করেছিল। তবে এই অর্থ তাদের আরামদায়ক জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট ছিল না। বেশিরভাগ বংশধর দরিদ্র অবস্থায় দিন কাটাতেন। তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল, এবং তাদের জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছিল। এমনকি তাদের উপর কড়া নজরদারি রাখা হত, যাতে তারা কোনো বিদ্রোহ বা ষড়যন্ত্রে জড়িত হতে না পারে।

 

ব্রিটিশ নীতি ও এর প্রভাব

ব্রিটিশদের এই নীতি মুঘল বংশধরদের মধ্যে এক ধরনের নির্ভরশীলতা এবং অসহায়ত্ব তৈরি করেছিল। তাদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থান ধীরে ধীরে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ে। অনেক বংশধরকে পেশাগত জীবনে প্রবেশ করতে বাধ্য করা হয়। তবে তাদের রাজকীয় পরিচয় তাদের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

সম্রাটের পরিবারের চারটি ঘর, খাবার-খরচ দিনে ১১ টাকা

বাহাদুর শাহ জাফর, মোগল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট, তার জীবনের শেষ দিনগুলো অত্যন্ত দুঃখজনক ও সীমিত উপায়ে কাটিয়েছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের অধীনে দিল্লির মোগল সাম্রাজ্য প্রায় শেষ হয়ে গেলে, ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পরে তাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়।

তাকে বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) রেঙ্গুনে (বর্তমান ইয়াঙ্গুন) পাঠানো হয়েছিল, যেখানে তিনি ও তার পরিবার অত্যন্ত সীমিত সম্পদে জীবনযাপন করতেন। তাদের থাকার জন্য ছোট চারটি কক্ষ বরাদ্দ ছিল এবং তাদের দৈনন্দিন খরচের জন্য মাত্র ১১ টাকা দেওয়া হতো।

এত সামান্য অর্থ দিয়ে একটি পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানো অত্যন্ত কষ্টকর ছিল। এই পরিস্থিতি মোগল সাম্রাজ্যের এককালের সমৃদ্ধি এবং রাজকীয় জীবনধারার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র তুলে ধরে। বাহাদুর শাহ জাফর তার নির্বাসনে কবিতা লিখে নিজের দুঃখ-কষ্ট প্রকাশ করেছিলেন। তার কবিতাগুলোতে তার হারানো সাম্রাজ্য, ভগ্ন হৃদয়, এবং মানবতার প্রতি তার গভীর উপলব্ধির প্রতিফলন পাওয়া যায়।

বাহাদুর শাহ জাফরের বংশধরদের কবিতা

বাহাদুর শাহ জাফর, মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ দ্বিতীয়, একজন সংস্কৃতিমনা ও প্রতিভাবান কবি ছিলেন। তার কবিতায় সাধারণত প্রথাগত কবিতার সাথে সাথে শোক, প্রেম ও দুঃখের গভীর অনুভূতি প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ফার্সি ও উর্দু ভাষায় কবিতা রচনা করতেন। তার কিছু কবিতা সম্রাটের অরাজক পরিস্থিতি, ব্যর্থতা, দুঃখ, এবং মুঘল সাম্রাজ্যের পতনকে প্রতিফলিত করে।

একটি বিখ্যাত কবিতা যা তিনি লিখেছিলেন:

“লুকালো নয়ন মণি, বেলা হারালো মন,
সত্যি বাঁচলে সব হারায় চুপি চুপি ধন।
আমার পাশে থাকলে, তুমি যে ছিলে সঙ্গী,
তুমি ছাড়া আর কিছু খুঁজে পাব না আমি।”

এতে তার প্রেম, শোক ও বিরহের অনুভূতি ফুটে ওঠে। বাহাদুর শাহ জাফরের কবিতায় মুঘল সম্রাজ্যের পতন, সংগ্রাম, এবং ব্যক্তিগত দুঃখপ্রকাশের প্রচুর উদাহরণ রয়েছে। তিনি ভারতের ইতিহাসে একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হলেও, তার কবিতা সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশেষ মূল্যবান।

জাফর-পুত্রদের হত্যা

বাহাদুর শাহ জাফর ছিলেন মোগল সম্রাট এবং ১৮৫৭ সালের ভারতীয় বিদ্রোহের সময় সম্রাট হিসেবে রাজত্ব করেছিলেন। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা বাহাদুর শাহ জাফরকে আটক করে দিল্লি থেকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয় এবং তাঁকে সম্রাট হিসেবে অস্বীকার করে।

 

ব্রিটিশরা বাহাদুর শাহ জাফরের পুত্রদের হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়, যেহেতু তারা বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল এবং সম্রাটের পক্ষে লড়াই করেছিল। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর বাহাদুর শাহ জাফরের পুত্র, মিরজা মুগল ও মিরজা খিজির, সহ অন্যান্য সদস্যদের আটক করা হয়।

 

১৮৫৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর, ব্রিটিশ বাহিনী মিরজা মুগল এবং মিরজা খিজিরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। তাদের গুলি করে হত্যা করা হয় এবং তাদের মৃতদেহ শহরের সন্নিকটে একটি খালে ফেলে দেওয়া হয়। এছাড়া, বাহাদুর শাহ জাফরের আরও কিছু পুত্র ও আত্মীয়দেরও বন্দি করা হয় এবং অনেককেই হত্যার শিকার হতে হয়।

উপসংহার

বাহাদুর শাহ জাফরের বংশধরদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব ব্রিটিশ সরকার নিয়েছিল তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য। এটি ছিল একটি রাজনৈতিক কৌশল, যা মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতীকী গুরুত্বকে ধ্বংস করার জন্য প্রণীত। যদিও এটি মানবিকতার মুখোশে লুকানো ছিল, এর আসল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা। ইতিহাসের এই অধ্যায় আমাদের শাসনব্যবস্থা এবং শক্তির রাজনীতি সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top