মাদার তেরেসা বিখ্যাত কারণ তিনি দরিদ্র, অসুস্থ এবং অনাথ মানুষের সেবায় তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি ১৯১০ সালে আলবেনিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯২৮ সালে রোমান ক্যাথলিক মিশনারি হয়েছিলেন।
১৯৫০ সালে তিনি কলকাতায় মিশনারিজ অফ চ্যারিটি নামে একটি ধর্মীয় সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংস্থাটি গরীব, অসুস্থ এবং অনাথ মানুষের জন্য হাসপাতাল, আশ্রয় এবং স্কুল পরিচালনা করে।
মাদার তেরেসার কাজ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। তিনি ১৯৭৯ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি ১৯৯৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন, তবে তাঁর কাজ আজও অব্যাহত রয়েছে।
মাদার তেরেসার বিখ্যাততার কারণগুলির মধ্যে রয়েছে:
- তাঁর নিঃস্বার্থ সেবা: তিনি দরিদ্র, অসুস্থ এবং অনাথ মানুষের জন্য তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি তাদের প্রতি গভীর সহানুভূতি এবং ভালোবাসা পোষণ করতেন।
- তাঁর আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি: তিনি বিশ্বাস করতেন যে প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে ঈশ্বরের প্রতিফলন রয়েছে। তিনি এই বিশ্বাসকে তাঁর কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন।
- তাঁর আন্তর্জাতিক প্রভাব: তাঁর কাজ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। তিনি অনেক মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করেছেন।
মাদার তেরেসা একজন মহৎ এবং অনুপ্রেরণামূলক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তাঁর কাজের মাধ্যমে বিশ্বকে আরও ভাল জায়গা করে তুলেছেন।
জন্ম ও পরিচয়
মাদার তেরেসা জন্মগ্রহণ করেন ১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট আসবেনিয়ার স্কপিয়েতে । তিনি ছিলেন পিতার তিন সন্তানের মধ্যে সবার ছোট ।
তাঁর পিতার নাম বোজাঝিউ , আর মাতার নাম দ্রানাফিল বার্নাই । মাদার তেরেসার প্রকৃত নাম অ্যাগেনেস গোনজা বোজাঝিউ । মাত্র ১২ বছর বয়সে অ্যাগনেস জান্নাসব্রক গ্রহণ করেন । তখন তাঁর নতুন নাম হয় মাদার তেরেসা ।
তৎকালীন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ( ১৯১৪) ভয়াবহতা ও লাখ লাখ মানুষের করুন মৃত্যু মাদার তেরেসার অল্প বয়সের মনকে কাঁদিয়েছিল । অন্যদিকে ১৯১৭ সালে পিতার মৃত্যু ও তাঁর জীবনে ডেকে আনে বিপর্যয় ।
মানুষের হাহাকার ও দুঃখ দুর্দশার আর মধ্যে তিনি বড় হয়ে ওঠেন । মানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার মন নিয়ে রুবান বঞ্চিত পীড়িত অবহেলিত মানুষের মাঝে কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ।
কর্মজীবনের প্রথম ধাপঃমাদার তেরেসা ১৯২৮ সালে কলকাতায় এলেন শিক্ষকতার কাজ নিয়ে। সেখানকার লোরেটো সেন্ট মেরিজ উচ্চ বিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষকতার শুরু । দীর্ঘ ১৮ বছর তিনি ভূগোল বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ।
স্কুলের কাজেই অবস্থিত একটি বস্তির আর্ত , দারিদ্র পিষ্ট রোগ-জর্জর মানুষের কাতরানি তাঁকে প্রবল নাড়া দিল । শিক্ষকতার মাঝে আর তিনি তৃপ্ত থাকতে পারলেন না ।
তাই শিক্ষকতার পাশাপাশি বস্তিতে গিয়ে অসহায় দুস্থ মানুষদের দারিদ্র যন্তনা প্রত্যক্ষ করতেন । এভাবেই মাদার তেরেসা পরদুঃখে কাতর হয়ে পড়তেন ।
কর্মজীবনের দ্বিতীয় ধাপঃ মাদার তেরেসা দীর্ঘকাল শিক্ষকতা শেষে ১৯৪৬ সালে দরিদ্র মানুষের সেবায় নিজেকে সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করার মহান দ্রত গ্রহণ করেন । আত মানুষের কান্না তাঁকে প্রবলভাবে আলোড়িত করত ।
তাই বৃহৎ জীবনের আহবানে সাড়া দিয়ে নেমে পড়লেন মানুষের কল্যাণে । ১৯৪৮ সালে তিনি ভারতীয় নারীর পোশাক পরিধান করেন । ভারতকে গ্রহণ করলেন নিজের দেশ হিসেবে । ১৯৪৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আশ্রয় নেন মাইকেল গোমেসের বাড়িতে ।
১৯৫০ সালে গঠিত হয় মিস নারিজ অব চ্যারিটিজ সংঘ । মহাতীর্থ কালীঘাটে ১৯৫০ সালেই প্রতিষ্ঠা করেননির্মল হৃদয় আশ্রম । অসহায় মানুষের জন্য মিলল মমতার আশ্রয়স্থল ।
বঞ্চিত ও পীড়িত মানুষেরা পেল নতুন জীবনের আশ্বাস । তাঁর নেতৃত্বে অনাথ শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠা করলেন নির্মলা শিশুভবন । হাওড়া এলাকায় গড়ে তুললেন পুষ্টাশ্রম ।
বাংলার সেবায় মাদার তেরেসাঃ বাংলাদেশের মানুষকে দুঃখ দুর্দশা মাদার তেরেসার মনকে খুবই তাড়িত করেছিল । তাই তিনি এদেশের মানুষের সেবায় এগিয়ে এসেছিলেন ।
মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশী শরণার্থীদের সেবাদান করেছিলেন মাদার তেরেসা । তিনি বাংলাদেশে আসেন ১৯৭২ সালে । বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যেমন খুলনা সাতক্ষীরা বরিশাল সিলেট আর কুলাউড়াতে নির্মল হৃদয় শিশুভবন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করেন ।
মিশনারিজ অব চ্যারিটিজজ এর শাখা স্থাপন করেন এদেশে । শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য গঠন করেন নবজীবন আবাস । কুষ্ঠু রোগীদের চিকিৎসা ও সেবার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘প্রেমনিবাস’ ।
১৯৮২সালে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত বৈরুত থেকে ৩৭ জন আহত শিশুকে নিয়ে আসেন । শিশুদেরকে সেবা যত্ন করে তিনি মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন
মাদার তেরেসার মূলমন্ত্র
মাদার তেরেসা তাঁর জীবনকে পুরোপুরি মানুষের কল্যাণে নিবেদিত করার মহৎ প্রত্যয় গ্রহণ করেছিলেন । তাঁর গড়ে তোলা মিশনারিজ অব চ্যারিটিজ জ এর মূল উদ্দেশ্য ছিল দারিদ্র্য জয় ।
চারিত্রিক সততা এবং আনুগত্য-এই তিন সত্যকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া । ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তাঁর উদ্যোগের জন্যই এই প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৫০ টি স্থানে শাখা স্থাপিত হয়।তাঁর সেবামূলক কর্ম কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডিরর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না ।
শুধু বাংলাদেশ বা ভারত নয় সমগ্র পৃথিবী জুড়েই গড়ে উঠেছে তাঁর সেবামূলক কার্যক্রম । যুগল শোকার্ত দারিদ্র পীরিত মানুষের পাশে তিনি ছুটে গেছেন পরম মমতার ছোঁয়া নিয়ে ।
দেশ ও কালের উদ্দেশ্য উঠে তিনি পরম ও দার্যের পরিচয় দিয়েছিলেন । হতে পেরেছিলেন পৃথিবীর অবহেলিত ও বঞ্চিত সর্ব মানবের আপনজন ।
পুরস্কারঃ মাদার তেরেসার জীবন ছিল সব দেশের আর্ত মানুষের সেবায় নিয়োজিত । তিনি কোনো জাতি ধর্ম বর্ণ ভেদ পছন্দ করতেন না । তাই কোনো ভৌগোলিক সীমানা তাঁর মহৎকর্মকে নির্দিষ্ট এলাকায় আটকে রাখতে পারেনি ।
এই অসামান্য মহত্বের কোনো তুলনা হয় না । ১৯৬২ সালে ভারত সরকার তাঁর জীবন ও মহৎ কর্মের জন্য তাঁকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করেন ।
এছাড়াও তিনি ১৯৭১ সালে পোপ জন পল এবং ১৯৭১ সালে জওহরলাল নেহরু পুরস্কারে ভূষিত হন । ফলে মানবতার সেবায় তার বিজয়বার্তা দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল ।
স্মৃকৃতিঃমাদার তেরেসার মতো একজন মহানুভব মানুষের সংস্পর্শ পেয়ে দেশে দেশে তাঁর মহত্বের গাথা ছড়িয়ে পড়ে । দুঃখী বঞ্চিত অবহেলিত পীড়িত মানুষের মমতার উৎস হয়েছিলেন মাদার তেরেসা ।
তাঁর ব্যথিত হৃদয় মহিমাময়ী চিরন্তন জননীর রুপ প্রত্যক্ষ করে অভিভূত হয়েছিল সারা বিশ্বের মানুষ । দিক- দিগন্ত থেকে একের পর এক আস্তে লাগলো তাঁর অসামান্য মহৎকর্মের প্রকৃতি ।
তিনি ফিলিপাইনের ম্যাগসেসাই পুরস্কারে ভূষিত হন । পেয়েছিলেন কেনেডি আন্তর্জাতিক পুরস্কার গুড সামারিটান পরিষ্কার’ ডক্টর অব হিউম্যান লেটার্স্স উপাধি ইত্যাদি ।
১৯৮০ সালে তাঁকে ভারতরত্ন উপাধিতে ভূষিত করা হয় । সারা পৃথিবীর কাছে তিনি মানবতার সেবায় অগ্রসর এক আলোকবর্তিকা হয়ে মর্যাদার স্থান পেলেন ।
নোবেল জয়ঃ অবশেষে মাদার তেরেসার সারা জীবনের সেবাকর্মের বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি মিলল । ১৯৭৯ সালে তাঁকে নোবেল পুরস্কারের ভূষিত করা হলো ।
তিনি নোবেল পুরস্কারের সমস্ত অর্থ ও আর্ত মানুষের সেবায় দান করতে ছিলেন। অন্যান্য সকল পুরস্কারের অর্থ ও তিনি একই উদ্দেশ্যে দান করে গিয়েছিলেন । তাঁর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো তিনি বিলাসিতা পছন্দ করতেন না ।
তাই নোবেল পুরস্কার প্রদান উপলক্ষে আয়োজিত ভোজসভা বাতিল করে সেই অর্থ ক্ষুধার্ত ও অসহায় মানুষের মাঝে ব্যয় করার জন্য তিনি অনুরোধ করেছিলেন ।
তাঁর এই আহবানে ভোজসভা বাতিল না হলেও সুইডেনের সাধারণ মানুষ এবং ছাত্র-ছাত্রীরা যে সাহায্য প্রদান করেছিল তা নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্যর তুলনায় প্রায় অর্ধেক ছিল ।
নাগরিকত্ব ও স্বীকৃতি
মাদার তেরেসার নিজস্ব কোনো দেশচিন্তা ছিল না । তিনি হয়ে উঠেছিলেন সকল দেশের সকল মানুষের । ১৯৮৫ সালে তিনি আমেরিকার সর্বোচ্চ নাগরিক স্বীকৃতি মেডেল অব ফ্রিডম এবং ১৯৯৬সালের ১৬ নভেম্বর আনাবারি ইউএস সিটিজেনসিভ লাভ করে বিশ্বের চতুর্থ ব্যক্তির স্থান দখল করেন ।
এছাড়াও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ও সেইন্ট অব দ্য গাটার্সপুরস্কার প্রদান করে সম্মানিত করা হয় । মাদার তেরেসা নিজেই যেন পৃথিবীর মানুষের জন্য এক অসামান্য উপহার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
অসামান্য সৃষ্টিকর্মঃ দীর্ঘকাল মানুষের সেবায় ব্রতী ছিলেন মাদার তেরেসা । তাঁর জীবন ছিল খুবই কর্মব্যস্ত । সেই ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি তাঁর সেবাব্রতেরবানীকে সকলের নিকট পৌঁছে দেওয়ার জন্য রচনা করেছেন অনেক গ্রন্থ ।
তাঁর এই সৃষ্টিকর্মের মূল প্রেরণা ছিল মানবসেবা । তাঁর উল্লেখ্যযোগ্য সৃষ্টিকর্মের মধ্যে রয়েছে মাই লাইফ ফর দ্য পুওর টোটাল সারেন্ডার লাভিং জিউস তেড়েজা কিসিং দ্য হার্ট অব গড; রিফ্রেকশন অন প্লেয়ার তেরেজা ইত্যাদি ।
এ সকল গ্রন্থে তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য ও মহৎপ্রাণের আর্তিপ্রকাশ পেয়েছে । পৃথিবীর মানুষের জন্য রেখে যাওয়া মাদার তেরেসার গ্রন্থগুলো এক অসামান্য সৃষ্টিকর্ম । তাঁর এই অবদান মানুষ শ্রদ্ধাভয়ে স্মরণ করবে ।
তিরোধানঃ পৃথিবীর সকল মানুষের প্রিয় ছিলেন মাদার তেরেসা। এই প্রিয় মানুষটি ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সময় রাত সাড়ে নয়টায় কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । তাঁর মৃত্যুতে সারা পৃথিবীর শোকার্ত হৃদয় সেদিন অশ্রু ভরে কেঁদেছিল ।
উপসংহারঃ আজীবন মানবসেবার নিবেদিত এক মহৎ প্রাণের নাম হল মাদার তেরেসা । পৃথিবীর কাছে এ অনুসরণীয় উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের মর্যাদায় তিনি অধিষ্ঠিত ।
বর্তমান সমাজের আর্ত পীড়িত ভাগ্যাগত বঞ্চিত অবহেলিত দারিদ্রকক্লিষ্ট অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে মাদার তেরেসার জীবন আমাদের পথ দেখায় ।
তাঁর অনুসৃত মানবতার জয়গানই আবার গাইতে হবে নতুন করে । তাহলেই মাদার তেরেসার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে ,সৃষ্টি হবে শান্তিপূর্ণ পৃথিবী ।